ও জেলো তুই গেলি সাগরে (o jelo tui geli sagore)
ও জেলো তুই গেলি সাগরে
আমি একলা থাকি ঘরে রে।
আমার মনে সুখ নাই রে
ও তুই ঘরে ফিরে আয় রে
ও জেলো তুর মাছের কপালে ছাই পড়ুক রে॥
ও জেলো তুই বোশেখ মাসে গেলি রে
জলদড়া খারুই লয়ে রে।
গাবরে কস্ করে জাল চুবালাম রে
আখার পাশে বসে বসে রে,
ও তু কবে আসবি ঘরে রে
সোনার যৈবুন আমার বৃথা যায় রে।
ও জেলো তুর মাছের কপালে ছাই পড়ুক রে॥
জ্যোষ্ঠি মাসে রে গাছে গাছে পাকা আম রে,
ও জেলো, তু নাই মোর ঘরে রে,
মিঠা আম কেবা আনে রে।
আমি রোদে ধুপে গোবর কুড়ুই রে, ঘসি দিই রে,
রাখাল ছোঁড়ারা আমার যৈবুন পানে তাকাই রে,
আমি মনের দুখে চোখের জল ফেলি রে
ও জেলো তুর মাছের কপালে ছাই পড়ুক রে॥
আষাঢ় মাসে রে মাঝ রেতে রে
ঝর্ ঝর্ ঝর্ ঝর্ আকাশ ঝরে রে।
পাউসেতে মাছ ওঠে রে,
মাঠে ঘাটে ছড়িবে পড়ে রে
রাখালে বাগানে কত মাছ ধরে রে॥
আমি যে যৈবুনে নারী, রেতে একলা যেতে নারি রে॥
ও জেলো তুর মাছে কপালে ছাই পড়ুক রে॥
শাউন মাসে রে মাঠে মাঠে রে,
জল থে থে করে রে।
মাঝে মাঝে কড়্কড়্ মেঘ ডাকে রে
বেশাল জালে ছাঁকি দিতাম রে।
তু নাই কাছে, বেশালের এক ধার কেবা ধরবে রে।
আমি যে যৈবুন নারী, কারবা সাথে বেশাল ধরবো রে।
ও জেলো তুর মাছের কপালে ছাই পড়ুক রে॥
ভাদর মাসে রে, জলে কাদায় রে,
যুবুতীরা সবার উপর শোস্ পাতে রে,
ভাঁজোর ছড়া গেয়ে গেয়ে গোল গোল হয়ে নাচে রে।
তালের বড়া পিটে করে রে, ভাতার পুতকে খাওয়ায় রে,
আমার ভাতার নাই কো ঘরে, আমার কোলে পুত নাই রে।
কার বা লেগে তালে পিটে বড়া করি রে।
ও জেলো তুর মাছের কপালে ছাই পড়ুক রে।
আশিন মাসে রে, আহা মাসের পুজো রে,
কত কত যুবুতী নারী রে,
তারা ভালো ভালো রঙিন শাড়ি পরে রে,
আমার জেলো নাই কো ঘরে রে,
কেবা শাড়ি কিনে দেয় রে,
আমি তেনা পিঁন্দা কাঁদি রে,
ও জেলো তুর মাছের কপালে ছাই পড়ুক রে॥
কার্তিক মাসে রে ধানের শীষে ফুল রে,
আলা দেখে পোকা মাকড় ঘরে আসে রে।
ছিঁড়া মশারিতে রে, পিনপিন করে মশা সিন্ধায় রে,
মশার কামড়ে জ্বলে মরি রে।
আমার জেলো আছে সাগরে,
কেবা শাড়ি কিনে দেয় রে।
ও জেলো, তুর মাছের কপালে ছাই পড়ুক রে॥
আগুন মাসে রে, চাষিরা সব লবান করে রে,
লগু চাল ভিজিয়ে গুড় কলা নারকেল মাথায় রে,
ঘরে ঘরে নতুন চালের ভাত রে,
আমার ঘরে নতুন চাল নাই রে,
দুখে আমার নয়ন ঝরে রে।
মাড়ে ভাতে খাই আমি রে।
ও জেলো, তুর মাছের কপালে ছাই পড়ুক রে॥
পউষ মাসে রে, জাড়ে হাত-পা ঠিটুরে যায় রে।
আমার গায়ে ছিঁড়া জামা রে,
পরনে ছিঁড়া তেনা রে,
ঘরে ঘরে চিতুই পিটে করে রে।
আমি জাড়ে মরি রে,
চিতুই পিটের আটা নাইকো রে।
ও জেলো, তুর মাছের কপালে ছাই পড়ুক রে॥
মাগ মাসে রে, মাঠের পুকুরে কত বেশাল জাল নামে রে
জোড়ে জোড়ে জেলো জেলেনীরা বেশাল টানে রে,
চিংড়ি পুঁটি গাগর বোয়াল ছিট্কি ধরে রে;
আমার মনের মানুষ নাই কো ঘরে রে —
কার বা সাথে বেশাল টানি রে।
আমি পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে কাঁদি রে॥
ও জেলো, তুর মাছের কপালে ছাই পড়ুক রে॥
ফাগুন মাসে রে, দখিন বাতাস বয় রে।
ভাতারের যুবুতীরা হাসি আমোদ করে রে,
আমি একলা থাকি ঘরে রে।
সোনার যৈবুন আমার বৃথা যায় রে,
চেংড়া ছোঁড়া আপাং এসে চোখ মারে রে,
আমি দা কাটারি লাল চোখ দেখায় রে।
ও জেলো, তুর মাছের কপালে ছাই পড়ুক রে॥
চৈত্রি মাসে রে, পাড়ার জেলেরা পুকুর জমা লয় রে॥
জেলেনীর চুপড়ি কাঁখে পাড়ায় মাছ লয়ে যায় রে,
আমি থাকি একলা একলা রে,
বোলানের দল পাড়ায় পাড়ায় গান করে রে,
পথের ধারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সঙ দেখি রে।
আমার জেলো নাইকো ঘরে রে, আমি মনের দুখে থাকি রে।
ও জেলো, তুর মাছের কপালে ছাই পড়ুক রে॥
ও আমার জেলো রে, সোনার জেলো রে —
দিন গেল মাস গেল বছর ঘুরে এলো রে,
তোর যৈবুন লয়ে আমি দুয়োরে বসে কাঁদি রে,
ও তু বাড়ি ফিরে আয় রে;
দুখের সাগরে ভাসি রে, হাত ধরে কেবা তোলে রে।
ও আমার সোনার জেলো, তু বাড়ি ফিরে আয় রে॥
দুখু মিয়া এ আসরে জেলেনীর দুখ গায় রে॥
- রচনাকাল: ১৯১০-১৯১২ খ্রিষ্টাব্দ (১৩১৭-১৩১৯ বঙ্গাব্দ)। বরধ্মান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে, নজরুলের ১১ থেকে ১৩ বৎসর বয়সের রচনা।
- গ্রন্থ:
- 'জেলে ও জেলেনী' পালার গান। ষষ্ঠ দৃশ্য। প্রথম গান। জেলে ও জেলেনির গান। নজরুল লেটো ও লোক-ঐতিহ্য। ওয়াকিল আহমদ। পৃষ্ঠা: ৫২-৫৬
- নজরুল-সংগীত সংগ্রহ [রশিদুন্ নবী সম্পাদিত। কবি নজরুল ইন্সটিটিউট। তৃতীয় সংস্করণ দ্বিতীয় মুদ্রণ, আষাঢ় ১৪২৫। জুন ২০০৩। লেটোগান। গান সংখ্যা ২৯৬৩]
- বিষয়াঙ্গ: জেলে ও জেলেনী পালার ষষ্ঠ গান। ভণিতা দুখু মিয়া।
সূত্র:
- নজরুল লেটো ও লোক-ঐতিহ্য। ওয়াকিল আহমদ। নজরুল ইন্সটিটিউট। বৈশাখ ১৪০৮।
- নজরুল সঙ্গীত-সংগ্রহ। নজরুল ইন্সটিউট, ঢাকা ফেব্রুয়ারি ২০১১।