কেন আসিলে ভালোবাসিলে দিলে না ধরা জীবনে যদি (keno ashile valobashile dile na dhora jibone jodi)

কেন আসিলে ভালোবাসিলে দিলে না ধরা জীবনে যদি।
বিশাল চোখে মিশায়ে মরু চাহিলে কেন গো বে-দরদি॥
            ছিনু অচেতন আপনা নিয়ে
            কেন জাগালে আঘাত দিয়ে
তব আঁখিজল সে কি শুধু ছল একি মরু হায় নহে জলধি॥
ওগো কত জনমের কত সে কাঁদন করে হাহাকার বুকেরি তলায়
ওগো কত নিরাশায় কত অভিমান ফেনায়ে ওঠে গভীর ব্যথায়।
মিলন হবে কোথায় সে কবে কাঁদিছে সাগর স্মরিয়া নদী॥

  • ভাবার্থ: এই গানে কবি ব্যর্থ প্রেমের আঘাতে জর্জরিত অভিমানী প্রেমিকের আক্ষেপকে তুলে ধরেছেন, করুণ রসের ভাবাবেগে। দয়িতার অবহেলায় অভিমানী প্রেমিকের স্বগতোক্তির মধ্য দিয়ে এই গানের আস্থায়ীর অবতারণা। প্রেমিক তার দয়িতার কাছে পরম আক্ষেপ নিয়ে বলছেন- 'যদি ভালোই বাসলে, তবে কেন জীবনসঙ্গী হয়ে ধরা দিলে না'। কেন প্রেমহীন মরুময় রুক্ষ চোখে নিষ্ঠুরের মতো দিকে তাকালে? অন্তরাতে সেই অভিমান আরও গভীর জীবনবোধকে স্পর্শ করে যায়।

    গভীর প্রেমের মোহে প্রেমিক নিজের জগতে নিজের মধ্যেই ডুবে ছিলেন। দয়িতার প্রণয়ের আঘাতে জেগে উঠেছিলেন প্রণয়ের কল্পলোক থেকে। প্রণয়ের বিরহজনিত বেদনায় দয়িতার চোখের জলকে কবি মনে করেছেন, প্রেমিকার ছলনা। প্রণয়ের বিরহজনিত বেদনায় প্রিয়ার চোখের জল তুলনীয় হয়ে উঠেছে মরুভূমির মরীচিকার মতো। তাতে ছলনা আছে, নৈরাশ্য আছে, প্রাপ্তির আশ্বাস বা বিশ্বাস নেই। নেই প্রেমসাগরের শাশ্বত গভীরতা।বহুদিনের পুঞ্জীভূত বেদনার হাহাকার প্রেমিকের হৃদয়ের গভীরতলকে আলোড়িত করে এবং অগণন নিরাশায় উথলে ওঠা অভিমান গভীর বেদনাকে জাগ্রত করে। কবি দয়িতার সাথে মিলনের আশা রাখতে পারেন না। যেমন- নদীর সাথে কবে কখন সাগরের মিলন হবে, এই কথা ভেবে কখনো নদী কাঁদে না। হয়তো তেমনি তাঁর দয়িতাও তাঁকে স্মরণ করে বেদনায় অশ্রুসজল হয়ে উঠবেন না। প্রেমিকের এই নিরাশা এবং আক্ষেপের ভিতর দিয়েই এই গানের সমাপ্তি ঘটে।

    গজলাঙ্গের এই গানটির সুরে পাওয়া যায়, ভৈরবীর শৃঙ্গার রসের বিরহের ভাব। নজরুল এই গানের বিরহ-ভাবকে ফুটিয়ে তোলার জন্য ভৈরবীর সাঙ্গীতিক স্বরগুচ্ছ ব্যবহার করেছেন নানা ভাবে।

    গানের সঞ্চারি তালহীন, গজলাঙ্গের গানের বিচারে যাকে শের বলা হয়। সঞ্চারীর তালহীন সুরেলা আবৃত্তি, স্রোতার মনে হৃদয়স্পরশী বেদনার সঞ্চার করে। গানটির তালের অংশটি কাহারবায় নিবদ্ধ। কিন্তু এর সমের আঘাত পরে শব্দের দ্বিতীয় ধ্বনিতে। এর ফলে গানের বাণী হয়ে উঠে বিশেষ অভিঘাতযুক্ত এবং তরঙ্গায়িত। গানের শুরুর '‌কেন' শব্দের 'ন' এর উপর যখন তালে সমের আঘাত পরে, তখন 'কেন' শব্দের প্রশ্নবোধকে উসকে দেয়। আর স সঋ ণ্ -এর ব্যবহারে 'কেন'  শব্দটির ভিতর দিয়ে জিজ্ঞাসা বা আকুতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এরপর ভালবাসিলে-এর 'লে' জ্ঞাঃ -মপদা -মপা জ্ঞা  স্বরবিন্যাসে বিরহ-বেদনা যেন আকুতি হয়ে ঝরে পড়ে।

    এরূপ এই গানের সর্বত্র পাওয়া যায় বাণী-ছন্দের খেলায় সুর-চিত্র। এই চিত্রে ব্যবহার করা হয়েছে ভৈরবীর করুণ-রসাত্মক সাঙ্গীতিক স্বরগুচ্ছ। যেমন- রাগ ভৈরবীর একটি বিশেষ সাঙ্গীতিক স্বরগুচ্ছ -'জ্ঞর রজ্ঞ ঋ স'। ভৈরবীর স্বরবিন্যাসে এই স্বরগুচ্ছ ভৈরবীর প্রশান্ত রূপকে করুণ রসে পরিণত করে। 'ফেনায়ে ওঠে গভীর ব্যথায়' এর শেষাংশে ব্যথ্যায় এই স্বরবিন্যাসে 'ব্যথা' করুণ রসে সিক্ত হয়েছে।

    সুরের চলনের সাথে তালের এই অভিঘাত ভাবের 'বিরহ-অভিমান' যেন সুর-সাগরে উথলে ওঠে। নজরুলের স্বকণ্ঠে গীতে রেকর্ডে সুরের এই তরঙ্গ মহিমান্বিত হয়ে ফুটে উঠেছে। তাঁর গাওয়া গানে পাওয়া যায়, বিরহ-অভিমান এবং প্রিয়াকে না পাওয়ার আকুতি- এ সব মিলে সৃষ্ট সুরচিত্রে গানটি মহিমান্বিত হয়ে উঠেছে সুর-বাণী-ছন্দের ত্রিবেণীসঙ্গমে।

     
  • রচনাকাল ও স্থান:  গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের ১২ আগষ্ট (শুক্রবার ২৭ শ্রাবণ ১৩৩৯), মেগাফোন রেকর্ড কোম্পানি নজরুলের কণ্ঠে গানটি রেকর্ড করেছিল। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ৩৩ বৎসর ২ মাস। উল্লেখ্য রেকর্ডে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল (চৈত্র ১৩৩৯-বৈশাখ ১৩৪০) মাসে।
  •  গ্রন্থ
    • নজরুল গীতি, অখণ্ড
      • প্রথম সংস্করণ [আব্দুল আজীজ আল-আমান সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। ৬ আশ্বিন ১৩৮৫। ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮]
      • তৃতীয় সংস্করণ [ব্রহ্মমোহন ঠাকুর সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। ৮ মাঘ ১৪১০। ২৩ জানুয়ারি ২০০৪। গজল। ১৯২৬ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা ৫০৯]
      • পরিবর্ধিত সংস্করণ [আব্দুল আজীজ আল-আমান সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। বৈশাখ শ্রাবণ ১৪১৩। এপ্রিল-মে ২০০৬] ভৈরবী-গজল। ১৬৮২ সংখ্যাক গান। পৃষ্ঠা: ৩৩১।
    • নজরুল-সংগীত সংগ্রহ [রশিদুন্‌ নবী সম্পাদিত। কবি নজরুল ইন্সটিটিউট। তৃতীয় সংস্করণ দ্বিতীয় মুদ্রণ, আষাঢ় ১৪২৫। জুন ২০১৮। ১ম গান। পৃষ্ঠা ১]
    • নজরুল-সঙ্গীত স্বরলিপি। প্রথম খণ্ড। প্রথম প্রকাশ, তৃতীয় মুদ্রণ [কবি নজরুল ইন্সটিটিউট। অগ্রহায়ণ ১৪০২। নভেম্বর ১৯৯৫। ১ম গান। পৃষ্ঠা ২৫-২৭]
  • রেকর্ড: মেগাফোন রেকর্ড [এপ্রিল ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দ (চৈত্র ১৩৩৯-বৈশাখ ১৩৪০)। জেএনজি ৪৪। শিল্পী: কাজী নজরুল ইসলাম[ শ্রবণ নমুনা] [রেকর্ড-লেবেল চিত্র]
     
  • স্বরলিপিকার ও স্বরলিপি: সুধীন দাশ।  নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপি (প্রথম খণ্ড)। প্রথম প্রকাশ, তৃতীয় মুদ্রণ [কবি নজরুল ইন্সটিটিউট। অগ্রহায়ণ ১৪০২। নভেম্বর ১৯৯৫। প্রথম গান] [নমুনা]
     
  • সুরকার: কাজী নজরুল ইসলাম।
  • পর্যায়:

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।