ওরে ব্যাকুল বেণুবন (ore bekul benubon)

        ওরে ব্যাকুল বেণুবন!
        তোকে দিয়েই হতো শ্যামের মুরলী মোহন॥
        তোর শাখাতে লেগে আছে শ্যামের হাতের ছোঁওয়া।
        আজো কি তার পরশ-লোভে ডালগুলি তার নোওয়া।
        আমার পড়লো মনে তোরে দেখে ও-বেণুবন পড়লো মনে,
        বৃন্দাবনে যে সাতটি সুর বাজাত শ্যাম বাঁশির সনে॥
        তার প্রথম সুরে আয় আয় ব'লে গোপিকায় ডাকে দূরে,
        তার দ্বিতীয় সুরে বহে যমুনা উজান ব্রজকুমারী ঝুরে।
        তার তৃতীয় সুরে সেই সুরে বাজে তার পায়ের নূপুর
        সেই সুর শুনে নাচে বনের ময়ূর।
        শুনি চতুর্থ সুর গুরু-গম্ভীর রোল,
        মেঘে মৃদঙ্গ বাজে লাগে ঝুলনায় দোল্।
        পঞ্চম সুরে তার কোয়েলা বোলে
        ব্রজ-বসন্ত আসে মাতে হোরির রোলে।
        ষষ্ঠ সুরে কেঁদে ডাকে সে রাধায়
        সপ্তমে নিষাদ সে ভুবন কাঁদায়।
আখর: [নিষাদ সে তাই সাধ মিটিল না
        ডাকিয়া বাঁশির সুরে বধে হরিণীরে 
 নিষাদ সে
        তারে ভালোবেসে সাধ মেটে না 
 নিষাদ সে॥]

  • ভাবসন্ধান: কৃষ্ণের অবর্তমানে ব্রজবাসীর চেতনা-জড়িত কবির স্মৃতিকাতরতায় তিনি উঠে এসেছেন অপরূপ রূপমাধুর্যে। কৃষ্ণ তাঁর বাঁশির সাত সুরে ব্রজবাসীকে বিমুগ্ধ করে রাখে। তাঁর বাশির সুরে প্রেয়সীকে যেন প্রেমবাণে বশ করে। এই গানে কৃষ্ণের বাঁশীর মোহনীয় সুরের যাদুকরী প্রভাব উপস্থাপন করা হয়েছে।

    বিরহবিধূর স্মৃতিকতরতায় কবি ব্যাকুলে বেণুবনকে যেন স্মরণ করিয়ে দেন-  বেণুশাখা থেকেই তৈরি হয়েছিল মোহনীয় শ্যামের মুরলী নামক বাঁশি। তার শাখাতেই লেগে আছে শ্যামের হাতের ছোঁওয়া। তাঁর পরশ পাওয়ার লোভে বেণুবনের ডালগুলো নুয়ে পড়ে।  তাই বেণুবন দেখে কবির মনে জেগে ওঠে কৃষ্ণ-সঙ্গের মধুর স্মৃতি। কবি তার কল্পলোকের বিহারে ভাবেন- বাঁশের সাত সুরের প্রথম সুর, গোপীদের আয় আয় বলে ডাকে। দ্বিতীয় সুরে উজানে বহে যমুনা, যেন সে ব্রজকুমারী হয়ে কাঁদে। তৃতীয় সুরে বাজে কৃষ্ণের পায়ের নূপুর আর সে সুর শুনে নাচে বনের ময়ূর। চতুর্থ সুরে মেঘে মৃদঙ্গ বাজে গুরু-গম্ভীর রোল। সে ছন্দের ছোঁয়া লাগে ঝুলনের দোলনায়। কোকিলের সুর ধ্বনিত হয় পঞ্চম সুর। সে ধ্বনির দোলায় ব্রজধামে বসন্ত আসে, মেতে ওঠে ব্রজধাম হোরির কলরোলে। ষষ্ঠ সুরে বাঁশি যেন রাধাকে ডাকে সকরুণ রবে। আর সপ্তম সুর নিষাদ, সে যেন বাজে ভুবনকে কাঁদিয়ে। এখানে নিষাদ সুরের অঙ্গন ছেড়ে হয়ে যায় শিকারী। তার শিকারের সাধ মেটে না। বাঁশির সুরে ডেকে প্রেমবাণে হরিণরূপী প্রেয়সীকে বধ করে। তাকে ভালোবেসে সাধ মেটে না বলেই সে, বার বার শিকার করে নিষাদ (শিকারী) হয়ে।

     
  • রচনাকাল ও স্থান: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ১১ জুন (রবিবার ২৮ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৬), কলকাতা বেতার কেন্দ্রের সান্ধ্য অনুষ্ঠান (৮.১৫-৮.২৯)  বিজন কুমার ঘোষ, প্রথম এই গানটি পরিবেশন করেছিলেন। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ৪০ বৎসর ১ মাস।
  • গ্রন্থ: নজরুল-সঙ্গীত সংগ্রহ [নজরুল ইনস্টিটিউট ফেব্রুয়ারি ২০১২। গান সংখ্যা ১৩১৭।  পৃষ্ঠা: ৩৯৮-৩৯৯]
  • বেতার: কলকাতা বেতার কেন্দ্র। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ১১ জুন (রবিবার ২৮ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৬)। সান্ধ্য অনুষ্ঠান। ৮.১৫-৮.২৯।  বিজন কুমার ঘোষ। [সূত্র: বেতার জগৎ। ১০ম বর্ষ, ১১শ সংখ্যা। ১ জুন ১‌৯৩৯। পৃষ্ঠা: ৪৩৪।
  • পত্রিকা: নজরুল একাডেমী পত্রিকা, ঢাকা [গ্রীষ্ম ১৩৯৪]
  • পর্যায়:
    • বিষয়াঙ্গ: ধর্মসঙ্গীত। সনাতন হিন্দুধর্ম। বৈষ্ণব। কৃষ্ণ। অন্বেষণ

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।