ওরে ভবের তাঁতি! হরিনামের এঁড়ে গরু (ore bhober tati! horinamer ere goru)

ওরে ভবের তাঁতি! হরিনামের এঁড়ে গরু কিনিস্‌ নে।
তুই মূলে শেষে হাবাত্‌ হবি ঠাকুরকে তুই চিনিস্‌ নে।
রসিক ঠাকুরকে তুই চিনিস্ নে॥
তুই খাচ্ছিস, বেশ ভবের তাঁতে বু’নে
চালিয়ে মাকু, ঘুরিয়ে টাকু, তাঁতের গান শু’নে
(ও তুই) সুখে খাবি আয়েশ পাবি
ঐ গরু কেনার টাকাতে তুই জরু আনার জিনিস নে॥
পরমার্থের কিন্‌লে এঁড়ে, অর্থ যাবে ছেড়ে
তোর ঘাড়েরই লাঙল তোকে শেষে আসবে তেড়ে!

কুল যাবে তোর, যাবে জাতি মান
(এই গো-কুলের এঁড়ে এনে) যাবে জাতি মান,
দুঃখ অভাব শোক এসে তোর ধরবে রে দুই কান
শেষে কি কান খোয়াবি কানা হবি ভ’জে কানাই শ্রীকৃষ্ণে॥

  • ভাবসন্ধান: এই গানে হরিভক্তিকে কবি ভব সংসারে গৃহীর যাপিত জীবনের বিচারে উপস্থাপন করেছেন। বৃন্দাবনের রঙ্গ-লীলীময় শ্রীকৃষ্ণকে গো-কুলের এঁড়ে নামে অভিহিত করা হয়েছে। বৃন্দাবন লীলায় মজে এই এঁড়ে গরুকে মনে প্রাণে স্থান দিলে, গৃহীর সংসার অসহনীয় দশায় পড়বে। তাই কবি গৃহীকে হরিনামের এই এঁড়ে গরু কিনতে নিষেধ করেছেন।

    সংসার জীবনে গৃহী 'ভবের তাঁতি। আর গৃহীর সংসার-প্রতিপালন হলো- ভাবের তাঁতে বস্ত্র বয়নের মতো। হরিভক্ত নামক  গার্স্থ্যজীবন চলে না। এই গরু সংসারের চাওয়া-পাওয়ার প্রত্যাশা পূরণের বদলে গৃহীকে বঞ্চিত করে। এই এঁড়ে গরুকে ভরসা করে তাকে ঘরে স্থান দিলে শেষ পর্যন্ত হাভাত  দশায়  (নিরন্ন দশা) পড়তে হতে হয়। কবি সংসারের স্বরূপ জানেন, তাই নিজের এবং অন্যের প্রতি তাঁর এই সতর্ক বার্তা।

    কবি হরিকে রসিক অভিধায় ভূষিত করেছেন। কারণ সংসারের সকল আনন্দ-বেদনা যেন হরির রঙ্গ-লীলা। সে রঙ্গলীলা সংসার নামক ভবের তাঁতে ভ্রাম্যমান মাকু হয়ে গৃহী দিনাতিপাত করেন। এর সাথে সুতো থাকে সুতা কাটার টাকু। ভাবের তাঁতে বস্ত্র বুনে, ভবের গান (সংসারের গুণকীর্তন) শুনে আরামে দিন চলে যাবে- এটাই সত্য। এমন কি ওই এঁড়ে গুরুর কেনা টাকার পরিবর্তে ঘরে জরু (স্ত্রী) এনে সংসারী হবে মানুষ।

    বৃন্দাবনের গো-কুলের এঁড়ে (কৃষ্ণ), সংসারে স্থান দিলে- গোকুলের গোপিণীদের মতো জাত কুল যাবে। কৃষ্ণভক্তে কালাতিপাত করলে, দুঃখ-অভাব শোক সংসারে জেঁকে বসবে। কবি এখানে কান, কানা এবং কবি শব্দের খেলা খেলেছেন।  ব্রজের কানাই হলেন শ্রীকৃষ্ণ। এই ব্রজের রঙ্গলীলার এই কানাইকে ভজনা করলে, সংসারের অভাব এসে অসহায় গৃহীর কান ধরবে। অদূরদ্শিতার কারণে গৃহী  কানার মতো সংসারের কর্তব্য পালনে অক্ষম হয়ে যাবেন।

    টীকা: বয়ন শিল্পে টানা সুতোর ভিতর দিয়ে সুতাযুক্ত মাকু নামক ডিভাইস চালনা করা হয়। তাঁতের টানাসুতোর ভিতর দিয়ে মাকুর আসা-যাওয়ার কার্ক্রমে বস্ত্র তৈরি সম্পন্ন হয়। 

     
  • রচনাকাল ও স্থান:  গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর (আশ্বিন-কার্তিক ১৩৪৫) মাসে, এইচএমভি রেকর্ড কোম্পানি গানটির রেকর্ড প্রকাশ করেছিল। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ৩৯ বৎসর ৪ মাস।
     
  • গ্রন্থ: নজরুল-সঙ্গীত সংগ্রহ [নজরুল ইনস্টিটিউট ফেব্রুয়ারি ২০১২। গান সংখ্যা ২৩৭৫। পৃষ্ঠা: ৭২৫]
  • রেকর্ড: এইচএমভি [অক্টোবর ১৯৩৮ (আশ্বিন-কার্তিক ১৩৪৫)]। এন ১৭২০৩। শিল্পী: হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।
     
  • সুরকার: নজরুল ইসলাম
  • স্বরলিপি ও স্বরলিপিকার:
  • পর্যায়:
    • বিষয়াঙ্গ:  ধর্মসঙ্গীত। সনাতন হিন্দুধর্ম। বৈষ্ণব। হরি-ভক্তি।
    • সুরাঙ্গ: কীর্তনাঙ্গ

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।