আমি কেন হেরিলাম নব ঘনশ্যাম কালারে কাল্ কালিন্দী-কূলে (ami keno herilam nobo ghono shyam kalare)
আমি কেন হেরিলাম নব ঘনশ্যাম কালারে কাল্ কালিন্দী-কূলে।
(সে যে) বাঁশরির তানে সকরুণ গানে ডাকিল প্রেম-কদম্ব মূলে॥
কেন কলস ভরিতে গেনু যমুনা-তীরে,
মোর কলস সাথে গেল ভাসি, লাজ-কুল-মান আকুল নীরে।
কলসির জল মোর নয়নে ভরিয়া সই আসিনু ফিরে॥
সখি হে তোদের সে রাই নাই, গোকুলেই রাই গোকুলেই নাই,
এ-কূলে নাই ও-কূলে নাই, গোকুলের রাই গোকুলে নাই।
সে যে হারাইয়া গেছে শ্যামের রূপে লো নবীন নীরদে বিজলি প্রায়।
সে রবি-শশী সম ডুবিয়া গেছে লো সুনীল রূপের গগন-গায়॥
হরি-চন্দন-পঙ্কে লো সখি শীতল ক'রে দে জ্বালা,
দুলায়ে দে গলে বল্লভ-রূপী শ্যাম পল্লব মালা।
নীল কমল আর অপরাজিতার, শেজ্ পেতে দে লো কোমর বিথার
পেতে দে শয্যা পেতে দে, নীল শয্যা পেতে দে পেতে দে!
আমার শ্যামের স্মৃতির নীল শিখী-পাখা, চূড়া বেঁধে কেশে গেঁথে দে!
পরাইয়া দে লো সখি অঙ্গে নীলাম্বরী, জড়াইয়া কালো বরণ আমি যেন মরি॥
- ভাবসন্ধান: কৃষ্ণের প্রেমে আত্মহারা রাধার ব্যাকুলতার আক্ষেপ দিয়ে এই গান শুরু হয়েছে । দীর্ঘ এই গানটিতে ফুটে উঠেছে কৃষ্ণকে পাওয়ার জন্য রাধার আকুলতা। কৃষ্ণকে দেখার পর রাধার মনোলোকে যে রূপান্তর ঘটেছে, তারই দীর্ঘ বয়ানের মধ্য দিয়ে, গানটির শেষে ফুটে উঠেছে কৃষ্ণের কাছে তাঁর দেহ ও মনের পূর্ণ সমর্পণের কল্প-বিহার।
রাধা গিয়েছিলেন যমুনার কূলে। সেখানে তিনি দেখলেন নব ঘনশ্যামের অতুলনীয় রূপ, শুনলেন প্রেম-কদম্ব মূলে কৃষ্ণের সকরুণ বাঁশরির সুরলহরী। তিনি কৃষ্ণের প্রেমে মোহিত হলেন। সে প্রেমের বিহ্বল দশায় রাধার কলসি ভেসে গেল যমুনার জলে, ভেসে গেল লাজ-কুল-মান আকুল প্রেম-সলিলে। রাধা ফিরে এলেন, তাঁর কাঁখে জলভরা কলসি নেই, তার পরিবর্তে তাঁর দুই নয়নে নিয়ে এলেন বিরহে অশ্রুরাশি। রাধা অনুভব করলেন তাঁর নিজের বিবশা ভাব। রূপান্তরিত এই রাধা সখিদের কাছে আক্ষেপের সুরে বলেন- 'সখি হে তোদের সে রাই নাই, গোকুলেই রাই গোকুলেই নাই'। রূপান্তরিত এই রাধা নিজেকে গোপীদের গৃহবধু বলে নিজেকে ভাবতে পারেন না, আবার কূলত্যাগী কৃষ্ণের সঙ্গিনী হিসেবেও এই দাবি করতে পারেন না। তাই রাধা ভাবেন তিনি 'এ-কূলে নাই ও-কূলে নাই'।
কৃষ্ণের নব মেঘের বিজলী-সম মোহনীয় রূপে রাধা নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন, যেমন করে রবি-শশী হারিয়ে যায় সুনীল রূপ সমুদ্রে। কৃষ্ণ-প্রেমের দেহমনের জ্বালা নিবারণের জন্য, তিনি পেতে চান কৃষ্ণের স্পর্শ-আস্বাদনকারক নানা উপকরণ। তাই সখিদের ডেকে রাধা বলছেন- তাঁরা যেন হরির চন্দন-পঙ্ক লেপনে তাঁর অঙ্গজ্বালা নিবারণ করে দেন। কণ্ঠে পরিয়ে দেন বল্লভ-রূপী শ্যাম-পল্লব মালা। তিনি চান তাঁর পুষ্প-শয্যা রচিত হোক কোমর পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত নীল কমল আর অপরাজিতা দিয়ে। তাঁর কেশে শোভা পাক শ্যামের স্মৃতি স্বরূপ নীল ময়ূর-পাখা। তাঁর অঙ্গে জড়িয়ে থাক নীলম্বরী শাড়ি, যেন কৃষ্ণের কালো বর্ণ জড়ায়ে ধরে- প্রেমের অতুল আনন্দে বিলীন হতে পারেন।
- রচনাকাল ও স্থান: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। সঙ্গীত বিজ্ঞান প্রবেশিকা পত্রিকার 'কার্তিক ১৩৩২' (অক্টোবর-নভেম্বর ১৯৩১) সংখ্যায় গানটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। এই সময় নজরুলের এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ৩২ বৎসর ৫ মাস।
- গ্রন্থ:
- সুর-সাকী
- প্রথম সংস্করণ [আষাঢ় ১৩৩৯ বঙ্গাব্দ। জুলাই ১৯৩২]
- নজরুল রচনাবলী, জন্মশতবর্ষ সংস্করণ, চতুর্থ খণ্ড। বাংলা একাডেমী, ঢাকা। [জ্যৈষ্ঠ ১৪১৮, মে ২০১১। সুর-সাকী। ৫৫। কীর্তন পৃষ্ঠা: ২৫৪-২৫৫]
- নজরুল-সঙ্গীত সংগ্রহ [নজরুল ইনস্টিটিউট, মাঘ ১৪১৮। ফেব্রুয়ারি ২০১২। রাগ: গৌড় সারং। তাল: একতাল। গান সংখ্যা ১২২২। পৃষ্ঠা: ৩৭২]
- সুর-সাকী
- পত্রিকা:
- সঙ্গীতবিজ্ঞান প্রবেশিকা [কার্তিক ১৩৩৮ (অক্টোবর-নভেম্বর ১৯৩১)]। কীর্তন। [নমুনা]
- দুন্দুভি [২৪ শে সেপ্টেম্বর ১৯৩২ (শনিবার ৮ আশ্বিন ১৯৩৯)]
- রেকর্ড: টুইন [মার্চ ১৯৩২ (ফাল্গুন-চৈত্র ১৩৩৮)। এফটি ৮৬১। শিল্পী: আশ্চর্যময়ী দাসী]
- স্বরলিপি ও স্বরলিপিকার: আহসান মুর্শেদ [নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপি, একচল্লিশতম খণ্ড, অগ্রহায়ণ ১৪২৪] গান সংখ্যা ৬। পৃষ্ঠা: ৩৫-৩৯ [নমুনা]
- পর্যায়:
- বিষয়াঙ্গ: ধর্মসঙ্গীত। সনাতন ধর্ম। বৈষ্ণব। রাধা-কৃষ্ণ-লীলা। প্রণয় কামনা
- সুরাঙ্গ: কীর্তন
- তাল: দাদরা
- গ্রহস্বর: মা