কত ফুল তুমি পথে ফেলে দাও (koto ful tumi pothe fele dao)

কত ফুল তুমি পথে ফেলে দাও (প্রিয়) মালা গাঁথ অকারণে
আমি চেয়েছিনু একটি কুসুম সেই কথা পড়ে মনে॥
          তব ফুলবনে কত ছায়া দোলে
         ;জুড়াইতে চেয়েছিনু তারি তলে
চাহিলে না ফিরে চলে গেলে ধীরে ছায়া-ঢাকা অঙ্গনে॥
অঞ্জলি পাতি' চেয়েছিনু, তব ভরা ঘটে ছিল বারি
শুষ্ক-কণ্ঠে ফিরিয়া আসিনু পিপাসিত পথচারী।
          বহুদিন পরে দাঁড়াইনু এসে
          তোমারি দুয়ারে উদাসীন বেশে
শুকানো মালিকা কেন দিলে তুমি তব ভিক্ষার সনে॥

  • ভাবার্থ: এটি ব্যর্থ একটি প্রেমের করুণ রসের গান। দূর অতীতে প্রেমিকার অবহেলা প্রেমিকের মনে কঠিন হয়ে বেজেছিল, বহুদিন পরে তাই সে ফিরে এসেছে গৌরবহীন প্রণয় নিবেদন হয়ে। সে প্রেমলোকের প্রণয় প্রত্যাশী প্রেমিকের ঠাঁই ছিল না। তাই প্রেমিকের প্রণয় প্রার্থনা অবহেলায় উপেক্ষিত হয়েছে। প্রেমকাননে আশ্রয় প্রত্যাশী প্রেমিকের আকাঙ্ক্ষা ছায়ার মতই যেন মিলিয়ে গেছে। দূর অতীতে অনেক প্রেমিকার সাথে অনেক প্রেম-পুষ্পের খেলা করেছে, তা নিয়ে প্রেমিকার অভিমান নেই। আছে অবহেলার বেদনা। প্রেমিকা শুধু চেয়েছিল প্রেমিকের একটি প্রেমের স্পর্শ।

    ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে এইচএমভি থেকে প্রকাশিত এই গানের সুরারোপ করেছিলেন কমল দাশগুপ্ত। রেকর্ডে গানটির সুরের পরিচয় ছিল 'আধুনিক'। মূলত সুরকার এই গানের সুর রচনা করেছিলেন বিংশ শতাব্দীর আধুনিক গানের সুরশৈলীর স্বরবিন্যাস। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে হয়তো এই গানে জয়জয়ন্তীর ছায়াই পাওয়া যায়। অবশ্য কোমল ধৈবত ব্যবহারে ভৈরবীর কিছু আভাষ ফুটে মাত্র। এই বিচারে এই গানটিকে মিশ্র জয়জয়ন্তী বলা যেতে পারে। মূলত গানটির ভাবের সাথে সঙ্গতি রেখে  তৎকালীন আধুনিক বা প্রচলিত সুরের ঢং অনুসরণ করে কমল দাশগুপ্ত নিজের মতো সুর করেছিলেন। যদিও এই গানের সুরে পাওয়া যায় অভিমান ও বিরহের যুগপৎ অনুভাব। গানটির স্থায়ীতে শিল্পী সন্তোষ সেনগুপ্তর গায়কীতে এই যুগপৎ ভাবটিই পাওয়া যায়। স্থায়ীর 'পড়ে মনে' শব্দ দুটি 'পা মা মদঃ পঃ' স্বর বিন্যাসে ব্যবহৃত কোমল ধৈবত (দ) ব্যবহার করা হয়েছে, 'মনে পড়ে' পৃথক অভিব্যক্তি  এনে দেয়। প্রেমিকের প্রেমের ফুল অবহেলায় ফেলে দেয়া একটি বিবরণ মাত্র। এর ভিতরে বিশেষ ঘটনাটিই হলো- একটি প্রেমের কুসুম প্রার্থনা, এবং সেই প্রার্থনার কথা মনে পড়ে যাওয়া।

    অন্তরাতে প্রেমিকার ব্যর্থ প্রেমের হাহাকার হয়ে উঠেছে 'চেয়েছিনু' শব্দটি 'র্গরম র্গর্মর্গা র্রা' স্বর বিন্যাসে। এই হাহাকার পাওয়া 'চাহিলে না'র 'না'-তে নর্রা র্সনর্স'। এখান থেকে সুরে আসে সুরচিত্র হয়ে গমা হয়ে। এরূপ সুরচিত্র গানটির সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। বাড়তি সুরালঙ্কারের ব্যবহার থাকলেও তা সুরের ভাবের ব্যাঘাত ঘটায় নি। গানটি ২।২ মাত্রা ছন্দে নিবদ্ধ। এই ছন্দটি বাণী ও সুর ছোটো ছোটো অভিঘাতে বিশেষ আবেদন তৈরি করে।

    প্রেমিকার প্রণয়-বারি সিঞ্চনের আশায়, প্রেমপিয়াসী প্রেমিক অধীর ছিল। কিন্তু ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে, চির-প্রেম-পিয়াসী হয়েই তাঁকে ফিরে যেতে হয়েছে। তারপর বহুদিন কেটে গেছে। জীবনের শেষ বেলায়, প্রেমিক উদাসিন বেশে প্রেমিকার কাছে এসেছে- সব -হারানোর বেদনায়। শেষ পর্যন্ত প্রেমিকা তাঁকে বরণ করেছে। ততদিনে শুকিয়ে গেছে প্রেমিকের যৌবনের সরস আকাঙ্ক্ষা। শুকিয়ে গেছে প্রেমিকার সরস প্রণয়পুষ্প। তাই প্রেমিকের কাছে প্রেমিকার প্রণয়মালিকা মনে হয়েছে প্রাণহীন, রসহীন, সৌরভহীন উপকরণ মাত্র। প্রেমিকের কাছে মনে হয়েছে, যা হতে পারতো ভালোবাসার কাঙ্ক্ষিত ধন, তাই হয়ে গেছে করুণা করে দেওয়া ভিক্ষার সামগ্রী। প্রেমিকার অবেলার এই দান হয়ে উঠেছে অবহেলার, অপমানের, করুণার।
     
  • রচনাকাল ও স্থান: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর (অগ্রহায়ণ-পৌষ ১৩৪৭) মাসে এইচএমভি রেকর্ড কোম্পানি থেকে এই গানটির প্রথম রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছিল। এ সময় নজরুলের বয়স ছিল ৪১ বৎসর ৬ মাস।
     
  • গ্রন্থ:
    • নজরুল গীতি, অখণ্ড
      • প্রথম সংস্করণ [আব্দুল আজীজ আল-আমান সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। ৬ আশ্বিন ১৩৮৫। ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮]
      • দ্বিতীয় সংস্করণ [আব্দুল আজীজ আল-আমান সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। ১ শ্রাবণ ১৩৮৮। ১৭ জুলাই ১৯৮১]
      • তৃতীয় সংস্করণ [ব্রহ্মমোহন ঠাকুর সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। ৮ মাঘ ১৪১০। ২৩ জানুয়ারি ২০০৪। কাব্য-গীতি]১৯২ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা ৫২]
      • পরিবর্ধিত সংস্করণ [আব্দুল আজীজ আল-আমান সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। বৈশাখ শ্রাবণ ১৪১৩। এপ্রিল-মে ২০০৬] ভৈরবী-গজল। ১৯২ সংখ্যাক গান। পৃষ্ঠা: ৩৮।
    • নজরুল-সংগীত সংগ্রহ [রশিদুন্ নবী সম্পাদিত। কবি নজরুল ইন্সটিটিউট। তৃতীয় সংস্করণ দ্বিতীয় মুদ্রণ, আষাঢ় ১৪২৫। জুন ২০১৮] ২য় গান। পৃষ্ঠা ১
    • নজরুল-সঙ্গীত স্বরলিপি  প্রথম খণ্ড। প্রথম প্রকাশ, তৃতীয় মুদ্রণ [কবি নজরুল ইন্সটিটিউট। অগ্রহায়ণ ১৪০২। নভেম্বর ১৯৯৫।] ২য় গান। পৃষ্ঠা ২৮-৩১
    • বুলবুল─দ্বিতীয় খণ্ড (গান, ১১ই জ্যৈষ্ঠ ১৩৫৯ বঙ্গাব্দ)। নজরুল-রচনাবলী─ষষ্ঠ খণ্ড [নজরুল জন্মশতবর্ষ সংস্করণ। বাংলা একাডেমী, ১২ই ভাদ্র ১৪১৪। ২৭শে আগস্ট, ২০০৭] ৮৪ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা ২৯৭
       
  • রেকর্ড: এইচএমভি [ডিসেম্বর ১৯৪০ (অগ্রহায়ণ-পৌষ ১৩৪৭)। এন ২৭০৫৭। শিল্পী: সন্তোষ সেনগুপ্ত।] [শ্রবণ নমুনা]

    সুরকার: কমল দাশগুপ্ত
     
  • স্বরলিপিকার ও স্বরলিপি: সুধীন দাশ। নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপি (প্রথম খণ্ড)। প্রথম প্রকাশ, তৃতীয় মুদ্রণ [কবি নজরুল ইন্সটিটিউট। অগ্রহায়ণ ১৪০২। নভেম্বর ১৯৯৫। দ্বিতীয় গান।] [নমুনা]
  • পর্যায়:
    • বিষয়াঙ্গ: প্রেম
    • সুরাঙ্গ: স্বকীয় বৈশিষ্ট্যর সুর। এই গানের সুর রচনা করেছিলেন বিংশ শতাব্দীর আধুনিক গানের সুরশৈলীর স্বরবিন্যাস। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে হয়তো জয়জয়ন্তী বা ভৈরবীর কিছু স্বরগুচ্ছ সন্ধান পাওয়া যায় বটে, কিন্তু কোনো বিশেষ রাগে নিবদ্ধ বলে দাবি করা যায় না। মূলত গানটির ভাবের সাথে সঙ্গতি রেখে কমল দাশগুপ্ত নিজের মতো সুর করেছিলেন। তাই বলা যায় এটি সুরকারের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের সুর।।
    • রাগ: রাগের উল্লেখ নেই। মিশ্র জয়জয়ন্তী
    • তাল: চতুর্মাত্রিক তাল (২।২ ছন্দ)
    • গ্রহস্বর: সা।

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।