নতুন পাতার নূপুর বাজে দখিনা বায়ে (notun patar nupur baje dokhina baye)

   তাল: দাদরা
নতুন পাতার নূপুর বাজে দখিনা বায়ে
কে এলে গো, কে এলে গো চপল পায়ে॥
ছায়া-ঢাকা আমের ডালে চপল আঁখি
উঠ্‌ল ডাকি' বনের পাখি 
 উঠ্‌ল ডাকি'।
নতুন চাঁদের জোছনা মাখি সোনাল শাখায় দোল দুলায়ে
কে এলে গো, কে এলে গো চপল পায়ে॥
সুনীল তোমার ডাগর চোখের দৃষ্টি পিয়ে
সাগর দোলে, আকাশ ওঠে ঝিল্‌‌মিলিয়ে।
পিয়াল বনে উঠল বাজি তোমার বেণু
ছড়ায় পথে কৃষ্ণচূড়া পরাগ-রেণু।
ময়ূর-পাখা বুলিয়ে চোখে কে দিলে গো ঘুম ভাঙায়ে।
কে এলে গো চপল পায়ে

  • ভাবার্থ: শীতের শেষে এসেছে বসন্ত। পত্রহীন বৃক্ষ-শাখা নতুন পাতায় ছেয়ে গেছে। দখিনা বাতাসে নব-পল্লবের আন্দোলনে মুখরিত হয়ে উঠেছে নৃত্যানন্দের নূপুরধ্বনি। কার স্পর্শে পল্লবে পল্লবে ছড়িয়ে পড়া এই নৃত্য-চাঞ্চল্য? এ ঔৎসুক্য চমক জাগিয়ে তুলেছে প্রকৃতির সাথে সাথে কবিচিত্তকে। স্থায়ীতে উচ্চারিত এই চমক বা বিস্ময় উৎসুক হয়ে মনে  জাগিয়ে তোলে বসন্তের আগমনবার্তা। স্বগোক্তিতে তার প্রকাশ ঘটে  'কে এল গো, কে এল গো চপল পায়ে'।

    অন্তরাতে এই বিস্ময় এবং ঔৎসুক্য সঞ্চালিত হয়- বসন্তের পাখির গেয়ে ওঠার ভিতরে, বসন্তের নতুন চাঁদের মধুজ্যোৎস্না অঙ্গসৌরভ হয়ে আন্দোলিত করে  সোনাল গাছের সোনালী ফুলকে। এ কার স্পর্শে!? স্বগোক্তির মতো অন্তরা শেষে তারই প্রকাশ ঘটে-'কে এল গো, কে এল গো চপল পায়ে'। সঞ্চারীতে কবি বসন্ত ঋতুকে রূপময়ী বসন্তললনারূপে উপস্থাপন করেছেন। এই বসন্তকন্যার  ডাগর চোখের অমিয়সুধা পান করে নীলসমুদ্র ছন্দিত হয় আর, আর তারই আবেশে নীলাকাশ বর্ণময় হয়ে ওঠে। বসন্তকন্যার স্পর্শে পিয়াল বন সুরে সুরে আন্দোলিত হয়, আর কৃষ্ণচূড়া যৌবন-উচ্ছলতায় পরাগরেণু ছড়িয়ে দেয় বন-প্রান্তরে। একইভাবে যেন ময়ূরের সুকোমল পালকের স্পর্শ, প্রকৃতিকে বসন্তোৎসবে জাগিয়ে তোলে। তাই প্রকৃতির বুকে চমকিত জিজ্ঞাসা বিস্ময়াবিষ্ট মুগ্ধতায় ছড়িয়ে পড়ে- 'কে এল গো,কে এল গো চপল পায়ে'।

    গানটিতে রয়েছে বসন্তরূপী প্রকৃতির নবযৌবনের আগমনের আগাম বার্তা, যার প্রকাশ পেয়েছে উচ্ছল চলচঞ্চল-সুরবিন্যাসে। দ্রুত দাদরায় নিবদ্ধ এ গানটিতে রয়েছে যেন নৃত্যশীলা বসন্তকুমারী লীলায়িত চপল ছন্দ। প্রকৃতির অনিয়মিত ছন্দ যেন বাঁধা পড়েছে তালের নিয়মিত শৃঙ্খলে। তাই বনের পাখির মধুঋতুর গান, সোনাল শাখার অনিয়মিত ছন্দ কিম্বা কৃষ্ণচূড়ার পরাগ ছড়ানোর খেলা-  হয়ে উঠেছে আনন্দ-হিল্লোলে নৃত্যময়। সব মিলিয়ে সুর ও বাণীর সুসমন্বয়ে মনের গভীর তলকে স্পর্শ করে যায়- 'কে এল গো'-এর বিস্ময়মাখা কৌতুহল।


    সুর বিন্যাসের বিচারে এটি কল্যাণ অঙ্গে ফেলা যায় বটে, কিন্তু বহুবিধ রাগের বিন্যাসে নজরুল গানটিকে রাগমালায় রূপান্তর করেন নি। বরং গানের ভাবের প্রকাশের জন্য সুরবিন্যাস করেছেন। তাতে কোনো কোনো রাগের আভাষ পাওয়া যায় মাত্র। তাই গানটির সুরকে নজরুলের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের গানের তালিকায় ফেলা যায়। শীতের ঘুম ভেঙে নব আনন্দে জেগে উঠার আনন্দ্-চাপল্য। ঈষৎ দ্রুত লয়ের ছন্দে এই সেই চাপল্য আনন্দ-তরঙ্গে প্রবাহিত হয়।
     
  • রচনাকাল ও স্থান: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি (পৌষ-মাঘ ১৩৪৭) মাসে সেনোলা রেকর্ড কোম্পানি গানটির প্রথম রেকর্ড প্রকাশ করেছিল। এই সময় নজরুল ইসলামের বয়স ছিল ৪১ বৎসর ৭ মাস। 
  • গ্রন্থ:
    • নজরুল গীতি, অখণ্ড
      • প্রথম সংস্করণ [আব্দুল আজীজ আল-আমান সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। ৬ আশ্বিন ১৩৮৫। ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮]
      • দ্বিতীয় সংস্করণ [আব্দুল আজীজ আল-আমান সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। ১ শ্রাবণ ১৩৮৮। ১৭ জুলাই ১৯৮১]
      • তৃতীয় সংস্করণ [ব্রহ্মমোহন ঠাকুর সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। ৮ মাঘ ১৪১০। ২৩ জানুয়ারি ২০০৪] কাব্য-গীতি। ৪০৭ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা ১০৬
      • পরিবর্ধিত সংস্করণ [আব্দুল আজীজ আল-আমান সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। বৈশাখ শ্রাবণ ১৪১৩। এপ্রিল-মে ২০০৬] ৪১২ সংখ্যাক গান। পৃষ্ঠা: ৭৮।
         
    • নজরুল-সংগীত সংগ্রহ [রশিদুন্ নবী সম্পাদিত। কবি নজরুল ইন্সটিটিউট। তৃতীয় সংস্করণ দ্বিতীয় মুদ্রণ, আষাঢ় ১৪২৫। জুন ২০১৮] ৩য় গান। পৃষ্ঠা ১
    • নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপি (প্রথম খণ্ড)। প্রথম প্রকাশ, তৃতীয় মুদ্রণ [কবি নজরুল ইন্সটিটিউট। অগ্রহায়ণ ১৪০২। নভেম্বর ১৯৯৫। ৩য় গান। পৃষ্ঠা: ৩২-৩৫]
    • বুলবুল─দ্বিতীয় খণ্ড [গান, ১১ই জ্যৈষ্ঠ ১৩৫৯ বঙ্গাব্দ]। নজরুল-রচনাবলী─ষষ্ঠ খণ্ড [নজরুল জন্মশতবর্ষ সংস্করণ। বাংলা একাডেমী, ১২ই ভাদ্র ১৪১৪। ২৭শে আগস্ট, ২০০৭।] ৯৫ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা ৩০২। পাঠ-শুকনো পাতার নূপুর বাজে।
    • হিন্দোল (প্রথম খণ্ড)। প্রথম প্রকাশ, দ্বিতীয় সংস্করণ [প্রকাশক, মফিজুল ইসলাম। আষাঢ়, ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ] ১ম গান। পৃষ্ঠা: ১-৩ পাঠ-কে এলে গো চপল পায়ে।
       
  • রেকর্ড: সেনোলা রেকর্ড। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দ [জানুয়ারি ১৯৪১ (পৌষ-মাঘ ১৩৪৭)। রেকর্ড নম্বর কিউএস ৫১০। শিল্পী: নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায়। সুরকার: নজরুল ইসলাম।' [শ্রবণ নমুনা]
     
  • স্বরলিপিকার ও স্বরলিপি: সুধীন দাশ।  নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপি (প্রথম খণ্ড)। প্রথম প্রকাশ, তৃতীয় মুদ্রণ [কবি নজরুল ইন্সটিটিউট। অগ্রহায়ণ ১৪০২। নভেম্বর ১৯৯৫। তৃতীয় গান'] [নমুনা]
     
  • সুরকার: কাজী নজরুল ইসলাম
  • পর্যায়:
    • বিষয়াঙ্গ: প্রকৃতি
    • সুরাঙ্গ: স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের সুর (কল্যাণ অঙ্গের আদলে)
    • তাল: দাদরা
    • গ্রহস্বর: পা।

 

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।