আসে বসন্ত ফুল বনে সাজে বনভূমি সুন্দরী (ase bosonto fulbone)

আসে বসন্ত ফুল বনে সাজে বনভূমি সুন্দরী,
চরণে পায়েলা রুমুঝুমু মধুপ উঠিছে গুঞ্জরি (আহা) ॥
দুলে আলোছায়া বন-দুকূল
ওড়ে প্রজাপতি কল্‌কা ফুল
কর্ণে অতসী স্বর্ণ-দুল্‌
                       আলোক-লতার সাতনরী॥
সোনার গোধূলি নামিয়া আয়
আমার রূপালি ফুল-শোভায়
আমার সজল আঁখি-পাতায়
                         আয় রামধনু রঙ ধরি'।
কবি, তোর ফুলমালী কেমন
ফাগুনে শুষ্ক পুষ্প-বন
বরিবি বঁধুরে এলে চ্যমন (আহা)
                   রিক্ত হাতে কি ফুল ভরি'॥

  • ভাবার্থ: প্রকৃতির বর্ণাঢ্য বসন্তের আগমনের উচ্ছ্বাসের সাথে মিশে গেছে, কবির জীবনসায়াহ্নের বর্ণহীন বিদায়-বেদনার কাতরতা। গানের প্রথমাংশে বসন্তকে আহবান করেছেন- পুষ্পসজ্জিত সর্বাঙ্গসুন্দরী বনললনাকে। আবার শেষ দুটি অন্তরায় মিশে গেছে সৌন্দর্যহীন আত্মনিবেদনের সুফিবাদী রহস্যময়তা। এর ফলে গানটি হয়ে উঠেছে- প্রকৃতি ও ভক্তিমার্গের যুগলভাবাশ্রিত।

    বসন্তের আগমনে প্রস্ফুটিত পুষ্পসজ্জায় বনভূমি সুন্দরী হয়ে উঠে। মধুকরের গুঞ্জরণ যেন তার পায়ে নূপুরের হয়ে বাজে। বনে বনে আন্দোলিত হয় বর্ণিল আলোছায়ার খেলা। প্রজাপতির রঙিন পাখার সাথে দোলে কল্‌কা ফুল। বনসুন্দরীর কর্ণে স্বরণ-দুল হয়ে অতসী দোল খায়, সাথে আলোক-লতা সাতনরী হার হয়ে তার বক্ষে দোলে। এর ভিতর দিয়ে কবি অনুভব করেন সুন্দরের বৈচিত্র্যময় লীলা।

    জীবন সায়াহ্নে এসে কবি অনুভব করেন যৌবনের পড়ন্ত বেলার জীবনের বর্ণহীন রুপালি পুষ্পের বিবর্ণতা। তাই তিনি বসন্তের সোনালি গোধূলিকে আহ্বান করেন বর্ণিল আবেশে। কবি কামনা করেন, তাঁর বিগত যৌবনে সজল আঁখি রঙিন হয়ে ওঠুক রঙধনুর রঙের ছোঁয়ায়।

    কিন্তু তেমনটা হয় না। তাই শেষ অন্তরায়- কবির ভণিতায় ফুটে ওঠে ফুলমালী-রূপী যৌবনের কাছে অভিমানী আত্ম-অনুযোগ। যে বনমালী তাঁর জীবনকে সর্বাঙ্গ-সুন্দর করে দিয়েছিল বসন্তের বনভূমির মতো। জীবন সায়াহ্নে এসে সেই বনমালী তাকে রিক্ত করে দিয়ে গেছে। তিনি অনুভব করেন যে, তাঁর জীবনের সে যৌবনপুষ্প শুকিয়ে গেছে। পুষ্পার্ঘ ছাড়া তাঁর পরম সত্যসুন্দরের পরানবঁধুকে কিভাবে বরণ করে নেবেন, এই হাহাকার নিয়েই কবি এই গানের সমাপ্তি টেনেছেন।

     
  • রচনাকাল ও স্থান: সওগাত পত্রিকার 'পৌষ ১৩৩৩ বঙ্গাব্দ' সংখ্যায় গানটির রচনার স্থান ও তারিখ উল্লেখ আছে- 'কৃষ্ণনগর, ২৮ অগ্রহায়ণ ৩৩'   [মঙ্গলবার, ১৪ ডিসেম্বর ১৯২৬। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ২৭ বৎসর ৬ মাস।

    গানটির পাদটীকায় উল্লেখ ছিল-  'বিখ্যাত উর্দু গজল ' 'কিস্‌কে খেরামে নাজ্‌নে কবর্‌মে দিল্ হিলা দিয়া'। উল্লেখ্য, ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণে মিশরের নৃত্যশিল্পী মিস্ ফরিদা কলকাতার আলফ্রেড রঙ্গমঞ্চে নৃত্য পরিবেশন করতে এসেছিলেন। সেই নৃত্যানুষ্ঠান নজরুল দেখেছিলেন। উর্দু গজল "কিসকি খায়রো ম্যাঁয় না জানি, মেঁ দিল হিলা দিয়া" সহযোগে উর্বশী ফরিদার লীলায়িত ভঙ্গিমার নাচ কবির মনে উদ্দি্‌পনার সঞ্চার করেছিল। তিনি এই গজল গানের অনুপ্রেরণায় ও সুরের কাঠামোয় ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের ২৮ অগ্রহায়ণ কৃষ্ণনগরে লিখলেন এই বাংলা গজলটি।
  • গ্রন্থ:
    • বুলবুল
      • প্রথম সংস্করণ [কার্তিক ১৩৩৫ (নভেম্বর ১৯২৮) গান ১০। ভীমপলশ্রী-দাদরা]
      • নজরুল-রচনাবলী, জন্মশতবর্ষ সংস্করণ। দ্বিতীয় খণ্ড [বাংলা একাডেমী, ফাল্গুন ১৪১৩। ফেব্রুয়ারি ২০০৭। বুলবুল। গান ১০। ভীমপলশ্রী-দাদরা। পৃষ্ঠা: ১৫৯।
  • পত্রিকা:  সওগাত। পৌষ, ১৩৩৩ বঙ্গাব্দ (ডিসেম্বর ১৯২৬-জানুয়ারি ১৯২৭) সংখ্যা।
  • নাটক: রক্তকমল । নাট্যকার শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। মঞ্চ─মনোমোহন থিয়েটার। উদ্বোধন─২ জুন, ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দ। চরিত্র─কমল। শিল্পী─শেফালিকা।
     
  • রেকর্ড: মেগাফোন। ফেব্রুয়ারি ১৯৩৩ (মাঘ-ফাল্গুন)  জেএনজি ৪৫। শিল্পী: আব্বাস উদ্দিন
  • ১ [শ্রবন নমুনা]
  • ২ [শ্রবন নমুনা]
  • স্বরলিপিকার ও স্বরলিপি:  সুধীন দাশ। [নজরুল-সঙ্গীত স্বরলিপি, পঞ্চম খণ্ড। কবি নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা] চতুর্থ গান। পৃষ্ঠা: ৪৭-৫০।  [নমুনা]
  • পর্যায়:

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।