ইসলামের ঐ সওদা লয়ে (islamer oi souda loye)

ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর।
বদ্‌নসীব আয়, আয় গুনাহ্‌গার নূতন করে সওদা কর॥
জীবন ভ'রে করলি লোকসান আজ হিসাব তার খতিয়ে নে;
বিনিমূলে দেয় বিলিয়ে সে যে বেহেশ্‌তী নজর॥
কোরানের ঐ জাহাজ বোঝাই হীরা মুক্তা পান্নাতে,
লুটে নে রে, লুটে নে সব, ভরে তোল্‌ তোর শূন্য ঘর।
কেয়ামতের বাজারে ভাই মুনাফা যে চাও বহুৎ 

এই ব্যাপারীর হও খরিদ্দার লও রে ইহার সিল-মোহর॥
আরশ হতে পথ ভুলে এ এলো মদিনা শহর,
নামে মোবারক মোহাম্মদ 
 পুঁজি 'আল্লাহু আকবর'॥

  • ভাবসনন্ধান: এই গানে ইসলাম ধর্মের মহিমা এবং ইসলাম ধর্ম প্রচারক হজরত মুহম্মদ (সাঃ)-এর গুণকীর্তন করা হয়েছে। নবি হিজরতে এসেছিলেন মদিনায়। এই গানের শেষ পঙ্‌ক্তিতে অনুসারে মনে হয় মদিনায় তাঁর আগমন এবং ধর্ম প্রচারের প্রথম পর্যায়কে তুলে ধরা হয়েছে। এই নব্য সওদাগরের নাম গানের শুরুতে প্রত্যক্ষভাবে পাওয়া যায় না। গানের শেষে অনেকটা ভণিতার মতো করে তাঁর নাম-পরিচয় দেওয়া হয়েছে।

    এ গানের ইসলামের সওদা (বাণিজ্য) হলো- ইসলামের আদর্শ গ্রহণের বিনিময়ে জান্নাত লাভের আশ্বাস। ধর্মজগতে নব্য ধর্ম ইসলামের সওদা করার জন্য এসেছিলেন এই নব্য সওদাগর তথা নবি। কবি ধর্মচ্যুত হতাভাগা আর পাপীদের আহ্বান করেছেন এই নব্য বাণিজ্যপণ্য ক্রয় করে লাভবান হওয়ার জন্য।

    কবি মনে করেন, সারাজীবন ধরে যা কিছু পার্থিব অর্জন করেছে বিপথগামী মানুষ। ধর্মাদর্শে তা সবই মূল্যহীন, সম্পদের তূল্যমূল্যের বিচারে পার্থব জগতের সকল অর্জনই লোকসানে পরিণত হয়েছে। এর জন্য লোভী মানুষকে অনেক মূল্যও দিতে হয়েছে। ইসলামের এই নব্য সওদাগর সব কিছুই মানুষের কল্যাণে বিনামূল্যে দিয়েছেন স্বরগীয় নজরানা হিসেবে। কিন্তু মানুষকে তা অর্জন করতে হবে- পাপ বিসর্জনের মধ্য দিয়ে। তাই নব্য সওদাগরের কাছে সওদা করার জন্য কবির এই আহ্বান।

    এই নব্য সওদাগর তাঁর পণ্য এনেছেন কোরআন নামক জাহাজে। সেখানে আছে হীরা মুক্তা পান্নার মতো মূলবান জ্ঞানরত্ন। কবি সবাইকে ডেকে বলছেন- এসব পণ্য লুট করে, নিজের জ্ঞানহীন আত্মার ঘরকে পূর্ণ করে নেবার জন্য। এখানে  লুট শব্দটি রূপাকার্থে ব্যবহার করা হয়েছ। এখানে লুট হলো- পাপ বিসর্জনের বিনিময়ে- অবাধে সম্পদ গ্রহণ। এই সম্পদের লাভ পার্থিব জগতের নয়। কেয়ামতের শেষে বিচারে দিনে পাওয়া যাবে এর মুনাফা। তাই কবি এই নব্য ব্যাপরীর খরিদার হ‌ওয়ার জন্য সবাইকে আহ্বান করেছেন। ইসলাম ধর্মমতে নবী তাঁর উম্মতের হয়ে আল্লাহর কাছে তাঁদের পাপ-মোচনের সুপারিশকারী হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। এর জন্য সকলের কাছে থাকতে হবে তাঁর উম্মতের সীলমোহর। একমাত্র ইসলামের ধর্মের আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে ওঠার মধ্যেই রয়েছে উম্মত হওয়ার সীলনোহর পাওয়ার শর্ত।

    ধর্মপ্রচারের জন্য মদিনায় নবির আসাটাকে- কবি তুলনা করেছেন আল্লাহর আরশ থেকে নেমে আসার রূপকতায়। এখানে কবি এই নব্য সওদাগরের নামোল্লেখ করে বলেছেন- 'নামে মোবারক-মোহাম্মদ' এবং তাঁর বাণিজ্যের মূলধন হলো 'আল্লাহু আকবর' (আল্লাহ মহান)।

     
  • রচনাকাল ও স্থান:  গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। জয়তী পত্রিকার 'কার্তিক-পৌষ ১৩৩৮' সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।  এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ৩২ বৎসর ৫-৬ মাস।


এই গানটি রচনার প্রসঙ্গে আব্বাসউদ্দীন আহমদ তাঁর 'আমার শিল্পী জীবনের কথা'  গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ইসলামী গানের রেকর্ড প্রকাশের ক্ষেত্রে গ্রামোফোন কোম্পানির রিহাসর্সল-ইন চার্জ ভগবতী ভট্টাচার্য রাজী ছিলেন না। এ নিয়ে আব্বাসউদ্দীন তাঁকে অনুরোধ করার পর, ভগবতী বাবু প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। পরে একদিন গ্রামোফোন কোম্পানির রিহাসর্সল রূপে  আব্বাসউদ্দীন তাঁকে দ্বিতীয়বার অনুরোধ করেন। এবারে বগবতী বাবু রাজী হন। এ প্রসঙ্গে 'আমার শিল্পী জীবনের কথা' [পরিবেশনা: হরফ প্রকাশনী, কলকাতা। পৃষ্ঠা: ৭৩] গ্রন্থে তিনি লিখেছেন-
 

আমি কাজিদাকে বললাম যে ভগবতীবাবু রাজী হয়েছেন। তখন সেখানে ইন্দুবালা কাজিদার কাছে গান শিখছিলেন। কাজিদা বলে উঠলেন, ইন্দু তুমি বাড়ী যাও, আব্বাসের সাথে কাজ আছে।" ইন্দুবালা চলে গেলেন এক ঠোংগা পান আর চা আনতে বললাম দশরথকে। তারপর দরজা বন্ধ করে আধঘণ্টার ভিতরই লিখে ফেললেন- ' ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ।" তখুনি সুরসংযোগ করে শিখেয়ে দিলেন। পরের দিন ঠিক এই সময় আসতে বললেন। পরের দিন লিখলেন, "ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এলো নবীন সওদার।"
 

  • আব্বাসউদ্দীনের এই বক্তব্য অনুসারে- 'ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ' এই সময়ে রচিত হলেও, আলোচ্য গানটি এই সময়ের রচিত নয়। কারণ, এই গানটি  জয়তী পত্রিকার কার্তিক-পৌষ ১৩৩৮ (অক্টোবর-ডিসেম্বর ১৯৩১) সংখ্যায় পূর্বেই প্রকাশিত হয়েছিল। সম্ভবত এইচএমভিতে  ' ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ" গানটি প্রকাশের সময় এর জুড়ি গান হিসেবে পূর্বে রচিত আলোচ্য গানটিতে সুরারোপ করেছিলেন।

রেকর্ড বুলেটিনে মন্তব্য ছিল- "আর একটি অভাব এতদিনে দূর হইল। বাংলা ভাষায় ইসলামী ধর্ম বিষয়ক রেকর্ডের জন্য অনুগ্রাহক বর্গ যেরূপ উৎসুক হইয়া আছেন উক্ত রেকর্ডখানি ততোধিক তৃপ্তি দিবে ইহাতে সন্দেহ নাই। এরূপ রেকর্ড আমাদের তালিকায় প্রথম।"

  • গ্রন্থ:
    • জুলফিকার
      • প্রথম সংস্করণ। ১৫ অক্টোবর ১৯৩২ (শনিবার ২৯ আশ্বিন ১৩৩৯)। ভৈরবী-কার্ফা।
      • নজরুল রচনাবলী, চতুর্থ খণ্ড [জ্যৈষ্ঠ ১৪১৪, মে ২০০৭, বাংলা একাডেমী। জুলফিকার। ১২ সংখ্যক গান। ভৈরবী-কার্ফা। পৃষ্ঠা: ২৯৭]
         
  • পত্রিকা: জয়তী [কার্তিক-পৌষ ১৩৩৮ (অক্টোবর-ডিসেম্বর ১৯৩১)]
  • রেকর্ড: এইচএমভি। ফেব্রুয়ারি ১৯৩২ (মাঘ-ফাল্গুন ১৩৩৮)। এন ৪১১১। শিল্পী: আব্বাসউদ্দীন আহমদ।  [শ্রবণ নমুনা]
  • স্বরলিপি ও স্বরলিপিকার:
  • পর্যায়:
    • বিষয়াঙ্গ: ধর্মসঙ্গীত। ইসলামি গান। বন্দনা। ইসলাম ও নবি। ইসলাম ধর্ম এবং নবি
    • সুরাঙ্গ: স্বকীয় বৈশিষ্ট্য

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।