জয় হরপ্রিয়া শিবরঞ্জনী (joy horopriya shibronjoni)

জয় হরপ্রিয়া শিবরঞ্জনী।
শিব-জটা হতে সুরধুনী স্রোতে ঝরি’ শতধারে ভাসাও অবনি।
দিবা দ্বিপ্রহরে প্রথম বেলা কাফি-সিন্ধুর তীরে কর খেলা
দীপ্ত নিদাঘে সারঙ্গ রাগে অগ্নি ছড়ায় তব জটার ফণী॥
কভু ধানশ্রীতে মায়া রূপ ধর,
জ্ঞানী শিবের তেজ কোমল কর
পিলু বারোয়াঁর বিষাদ ভোলানো
নূপুরের চটুল ছন্দ আনো
বাগীশ্বরী হ'য়ে মহিমা শান্তি ল'য়ে
আসো গভীর যবে হয় রজনী॥
বরষার মল্লারে মেঘে তুমি আসো,
অশনিতে চমকাও, বিদ্যুতে হাসো
সপ্ত সুরের রঙে সুরঞ্জিতা ইন্দ্রধনু-বরণী॥

  • ভাবসন্ধান:কলকাতা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত রাগভিত্তিক হরপ্রিয়া নামক নাটকের এটি প্রথম গান। বেতার জগতের '১ ডিসেম্বর ১৯৩৯' সংখ্যায় উল্লেখ করা হয়েছিল 'হরপ্রিয়া (কাফি ঠাটের রাগ-রাগিণী)'। উল্লেখ্য, দক্ষিণ ভারতে কাফি ঠাটের সমতুল্য মেল-এর নাম হরপ্রিয়া। আলোচ্য গানটি এই হরপ্রিয়া মেলের অন্তর্গত শিবরঞ্জনী। বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত আব্দুল কাদির সম্পাদিত 'নজরুল রচনাবলী'র তৃতীয় খণ্ডের ১৯৯৩ সংস্করণে 'হরপ্রিয়া' নাটকে এমন নির্দেশই পাওয়া যায়। সম্ভবত এই সূত্রে অন্যান্য সকল গ্রন্থে এই গানটির এমন তথ্যই পাওয়া যায়। ব্রহ্মমোহন ঠাকুর তাঁর 'নজরুল সঙ্গীত নির্দেশিকা' গ্রন্থে অবশ্য উল্লেখ করেছেন- 'রাগ শিবরঞ্জনী মিশ্র'। গানটির রাগ নিয়ে এতকথা বলার উদ্দেশ্য হলো- এই গানটি মূলত রাগের লক্ষ্মণগীত হিসেবেই কবি লিখেছিলেন। যেহেতু এই গানটির রাগের নির্দেশনা হিসেবে পাওয়া যায় শিবরঞ্জনী বা শিবরঞ্জনী মিশ্র। তাই সঙ্গত কারণে ধরেই নেওয়া যায়, গানটি শিবরঞ্জনী রাগের লক্ষ্মণগীত।

    প্রথমে এই গানে বর্ণিত রাগ-বিবরণের দিকে নজর দেওয়া যাক। গানটির শুরুতে 'হরপ্রিয়া শিবরঞ্জনী' মহিমা প্রকাশক সম্বোধন হিসেবে 'জয়' শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। একে আমরা শিষ্টাচার হিসেবে গণ্য করতে পারি। এরপর এর গুণকীর্তন করা হয়েছে একটি কাহিনি-উপমা'র মধ্য দিয়ে। প্রথগতভাবে কবি এই রাগের স্বাভবিক রূপকে বর্ণনা করেন নি। যেমন বাদী, সমবাদী, আরোহণ-অবরোহণ ইত্যাদির পরিচয় এই গানে নেই। কবি এই রাগের ভাবগত নানা রূপের মালা গেঁথেছেন, প্রকৃতির প্রহর-ভিত্তিক রূপের রূপান্তরের সূত্রে। তাই গানটির দ্বিতীয় পঙ্‌ক্তি তারই গৌরচন্দ্রিকা করেছেন পৌরাণিক কাহিনির রূপকতায়। দ্বিতীয় পঙ্‌ক্তিতে বলছেন- শিবের জটা বেয়ে নেমে আসা স্বর্গ-গঙ্গা যেমন শতধারায় পৃথিবীকে মহিমান্বিত করেছে, তেমনি এই রাগের সুরধ্বনি শতধারায় বা শতরূপে রাগ-পিপাসুর চিত্তের তৃষ্ণ মেটায়। প্রহরের পর প্রহর আসে, প্রকৃতি তার রূপ বদলায়। তার সাথে মানুষের অনুভবে জাগে কোমল-স্নিগ্ধ-কঠোর ইত্যাদি অনুভূতি। প্রাকৃতিক এই পরিবর্তনের প্রভাব ফেলে সঙ্গীতের সুর ধারায়। শিবরঞ্জনী অন্যান্য রাগের প্রভাবে প্রহরে প্রহরে যে রূপ পাল্টায় এবং প্রকৃতির অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে, কবি মূলত সে অনুভবকে তুলে আনার চেষ্টা করেছেন এই গানে।

    রাগের এই বহুরূপকতা উঠে এসেছে গানটির তৃতীয় পঙ্‌ক্তি থেকে। শাস্ত্রমতে শিবরঞ্জনী মধ্যম এবং নিষাদ বর্জিত ঔড়ব-ঔড়ব জাতির রাগ। ঠাট কাফি। শিবরঞ্জনীর স্বাভবিক পরিবেশনের সময় রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর। আবার শাস্ত্রমতে দিবা প্রথম প্রহরের প্রথম বেলার কাফি ঠাটের সিন্ধু (সিন্ধু-ভৈরবী)। এর স্বাভাবিক রূপ স্নিগ্ধ। কিন্তু যখন কাফি-সিন্ধুর আবির্ভাব ঘটে, তখন প্রভাতের স্নিগ্ধ-তেজদীপ্ত রূপ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।

    বেলা বাড়ে। প্রকৃতিতে রুদ্র শিবের তেজও বাড়ে। প্রথম প্রহর অতিক্রম করে দিবাভাগ দ্বিতীয় প্রহরে প্রবেশ করে। প্রকৃতি তেজদীপ্ত হয়ে ওঠে। শাস্ত্রমতে এই সময় আবর্ভাব ঘটে সারং অঙ্গের রাগসমূহ। শিবরঞ্জনীতে সারং-এর আবির্ভাবে রাগরূপে গ্রীষ্মের প্রখর অগ্নিঝরা রূপ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। দিবা দ্বিতীয় প্রহরের শেষে এসে সে তেজদীপ্তরূপ একটি স্থিতি দশায় আসে। কিন্তু সারং-এর তিরোধান ঘটিয়ে ধানশ্রীর আবির্ভাব হলে, কোমল রূপের প্রকাশ ঘটে।  ধানশ্রীর রাগে ব্যবহৃত হয় কোমল গান্ধার ও কোমল নিষাদ (জ্ঞানী)। সারং-এর প্রভাবে তেজদীপ্ত শিবরঞ্জনের রূপকে কোমল করে দেয় ধানশ্রীর কোমল গান্ধার ও কোমল নিষাদ। এখানে জ্ঞানী শিব হলো কোমল গান্ধার ও কোমল নিষাদযুক্ত শিবরঞ্জনী।

    দিবা দ্বিতীয় প্রহর শেষে আবর্ভাব ঘটে, দিবা-তৃতীয় প্রহরের কাফি ঠাটের রাগ পিলু। এর সাথে বারোয়াঁ যুক্ত হয়ে বিষাদের আবহ তৈরি করে। দিনের অবসান ঘটে। আসে মনোহর বিলাসী রাত্রি। সেখান পিলু-বারোয়াঁর আবির্ভাবে ঠুমরী চটুল ছন্দের আবর্ভাব ঘটে। আর রাত্রি দ্বিতীয় প্রহরে আবির্ভাব ঘটে রাগ বাগেশ্বরী (বাগেশ্রী)। এ রাগের প্রকৃতি গম্ভীর। তাই শিবরঞ্জনী এর প্রভাবে হয়ে শান্তির মহিমায় মহিমান্বিত হয়ে ওঠে।

    বর্ষার সকল প্রহরের রাগ মল্লার। তাই কবি প্রহরের প্রভাব ছেড়ে বর্ষাকে মেঘের বাহনে এনেছেন মল্লারকে। সাথে শিবরঞ্জনীকেও। বর্ষণমুখর রাত্রিতে মল্লারে আবির্ভাবে শিবরঞ্জনী বিদ্যুৎতের ছটার মতো চমক জাগায়।  মল্লারের আবর্ভাবে ঔড়ব-ঔড়ব জাতির শিবরঞ্জনী হয়ে ওঠে সপ্তসুরে বাধা সম্পূর্ণা। সব মিলিয়ে সপ্তস্বরে রঞ্জিতা শিবরঞ্জনী হয়ে সুরের ইন্দ্রধনু-বরণী।

     
  • রচনাকাল ও স্থান: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ১ ডিসেম্বর (শুক্রবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৩৪৬) তারিখে 'বেতার জগৎ' পত্রিকায় গানটি প্রকাশিত হয়েছিল। সম্ভবত এই পত্রিকায় প্রকাশের কিছু আগে গানটি রচিত হয়েছিল। এই সময় নজরুল ইসলামের বয়স ছিল ৪০ বৎসর ৬ মাস।
     
  • গ্রন্থ: নজরুল-সঙ্গীত সংগ্রহ (নজরুল ইনস্টিটিউট, মাঘ ১৪১৮। ফেব্রুয়ারি ২০১২)। ১৮৯৪ সংখ্যক গান। রাগ: শিবরঞ্জনী। পৃষ্ঠা: ৫৭১।
  • বেতার: হরপ্রিয়া (গীতি আলেখ্য: কাফি ঠাটের রাগ)। কলকাতা বেতার কেন্দ্র। [৫ ডিসেম্বর  ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দ (মঙ্গলবার, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৩৪৬)। সান্ধ্য অনুষ্ঠান। ৭.০৫-৭.৪৯।
    •  সূত্র:
      • বেতার জগৎ। ১০ম বর্ষ ২৩ সংখ্যা। অনুষ্ঠান সূচী। পৃষ্ঠা: ৯১৭
      • The Indian Listener (22 november 1939- Vol-IV-23. page 1627)
  • স্বরলিপি ও স্বরলিপিকার:
  • পর্যায়:
    • বিষয়াঙ্গ: ভক্তি [হিন্দুধর্ম, শাক্ত]
    • সুরাঙ্গ: খেয়ালাঙ্গ

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।