জাগো অনশন-বন্দী, ওঠ রে যত (jago onoshono bondi, otho re joto)
ইন্টারন্যাশনাল সঙ্গীতের সুর,
তাল: কাহার্বা
জাগো অনশন-বন্দী, ওঠ রে যত
জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত!
যত অত্যাচারে আজি বজ্র হানি'
হাঁকে নিপীড়িত-জন-মন-মথিত বাণী,
নব জনম লভি' অভিনব ধরণী ওরে ঐ আগত॥
আদি শৃঙ্খল সনাতন শাস্ত্র আচার
মূল সর্বনাশের, এরে ভাঙিব এবার।
ভেদি' দৈত্য-কারা আয় সর্বহারা;
কেহ রহিবে না আর পর-পদ-আনত॥
নব ভিত্তি 'পরে —
নব নবীন জীবন হবে উত্থিত রে!
শোন্ অত্যাচারী! শোন্ রে সঞ্চয়ী!
ছিনু সর্বহারা, হব সর্বজয়ী।
ওরে সর্বশেষের এই সংগ্রাম-মাঝ।
নিজ নিজ অধিকার জুড়ে দাঁড়া সবে আজ;
এই 'জনগণ-অন্তর-সংহতি' রে
হবে নিখিল মানব জাতি সমুদ্ধত॥
- ভাবার্থ: এটি কমুনিষ্ট পার্টির আন্তর্জাতিক সঙ্গীত। ফরাসি ভাষায় লেখা মূল গানের ইংরেজি অনুবাদ থেকে, কাজী নজরুল ইসলাম এই গানের অনুবাদ করেছিলেন। মুজাফ্ফর আহমেদ-এর অনুরোধে ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে কবি এই গানটির বাংলা অনুবাদ করেন। মুজফ্ফর আহমেদ- তাঁর 'কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা গ্রন্থে' এই অনুবাদ সম্পর্কে লিখেছেন 'বাঙলা ভাষার সর্বোৎকৃষ্ট অনুবাদ তো বটেই, আমার বিশ্বাস ভারতীয় ভাষাগুলিতে যতসব অনুবাদ হয়েছে সে-সবেরও সেরা। [বিস্তারিত: প্রাসঙ্গিক পাঠ] কমুনিষ্ট পার্টির জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে এই গানে পাওয়া যায়, অত্যাচারিত ও শোষিত মানুষ এবং সর্বহারাদের সুসংঘটিত বিদ্রোহের উদ্দীপনা। গানটির ভাবার্থ হিসেবে যা বলা যায়, তা হলো;
বিশ্বের সকল লাঞ্চিত, ক্ষুধাপীড়িত মানুষকে বজ্রকঠোর প্রতিবাদে উদ্বুদ্ধ করার আহ্বান করা হয়েছে এই গানে। চারিদিকে নিপীড়িত মানুষের হৃদয় মথিত যে আকাঙ্ক্ষার বাণী উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে, তার ভিতরে কবি অত্যাচারিত প্রাচীন পঙ্কিল জগতের বিনাশ অন্তে- নবতর কল্যাণকর এবং বিস্ময়কর জগত সৃষ্টির সম্ভাবনাকে তীব্রভাবে অনুভব করেছেন।
কবি মনে করেন, প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা যে শাস্ত্রীয় আচার মানুষকে বন্দী করে রেখেছে, তাই সকল সর্বনাশের মূল। এখন এই অটল দৈত্যের মতো অপরাজেয় অচল-দুর্গ ভাঙার সময় এসেছে। এই দুর্গের পতন হলেই কোনো মানুষ আর কারো পদানত থাকবে না, কোনো মানুষ অত্যাচারিত হবে না। কবি আরও মনে করেন, এই কল্যাণকর নতুন জগতের ভিত্তির উপরে, প্রতিষ্ঠিত হবে শোষণমুক্ত, অত্যাচার মুক্ত নতুন জীবনধারা। কবি অত্যাচারী শোষকদের উদ্দেশ্যে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে জানাচ্ছেন যে, এক সময় যারা সর্বহারা ছিল, তাদের জয় হবে সুনিশ্চিত। এই সংগ্রামকে চূড়ান্ত সংগ্রাম হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এই যুদ্ধে সকল সর্বহারা যদি সংঘবদ্ধরূপে আত্মপ্রকাশ করতে পারে, তাহলে বিশ্বের সকল মানুষ সমমর্যাদা প্রকাশের সূত্রে এক কাতারে এসে দাঁড়াতে পারবে। সবাই নিজ নিজ অধিকার নিয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারবে।
- রচনাকাল ও স্থান: ফণি মনসা কাব্যে অন্তর্ভুক্ত এই গানের সাথে রচনাকাল ও স্থানের উল্লেখ আছে ' কলিকাতা। ১লা বৈশাখ ১৩৩৪' (বৃহস্পতিবার, ১৪ এপ্রিল ১৯২৭)। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ২৭ বৎসর ১১ মাস।
উল্লেখ্য, গানটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল গণবাণী পত্রিকার '৮ই বৈশাখ ১৯৩৪' সংখ্যায়। গানটি গানটি ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে প্রকাশিত 'ফণি-মনসা' কাব্যে 'অন্তর-ন্যাশনাল সঙ্গীত' শিরোনামে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের জন্য লিখিত একটি জাতীয় সঙ্গীতের অনুবাদ। ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে মূল গানটি কবিতাকারে রচনা করেছিলেন প্রাক্তন ফরাসি কমুনিষ্ট পার্টির সদস্য এবং গীতিকার ইউগেন পট্টিয়ের (Eugène Pottier, ১৮১৬-১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দ)। এর এক বছর পর, ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে পিয়েরে ডি গেয়টার ( Pierre De Geyter, ১৮৮৪-১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দ) এই কবিতাটিতে সুরারোপ করেন। এই বৎসরের জুলাই মাসে এই গানটি প্রথম পরিবেশিত হয়। এরপর ধীরে ধীরে এই গানটি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। পিয়েরে এই গানের ৬০০০ কপি মুদ্রিত করে লিফলেট আকারে বাজারে ছাড়ে। কিন্তু পিয়েরের ভাই এ্যাডোলফি ধোকা দিয়ে এই গানের স্বত্বাধিকার দাবি করে। আদালতে দাবি প্রমাণ করতে না পারায়, ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে পিয়েরে তার স্বত্বাধিকার হারায়। এর প্রায় ৭-৮ বছর পরে পিয়েরের ভাই তার জালিয়াতি স্বীকার করে একটি চিরকুট রেখে আত্মহত্যা করে। এরপর ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে আদালতে আপিল করে পিয়েরে স্বত্বাধিকার লাভ করে। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে হ্যান্স আর বেইয়েরলেইন (Hans R. Beierlein) পশ্চিম ও পূর্ব জার্মানীতে বিক্রয় করার জন্য ৫,০০০ ডয়েস মার্কে মন্টানা সংস্করণ কিনে নেয়। পিয়েরে ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। ফলে এই গানটির উপর ২০০২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে তাঁর স্বত্বাধিকার উঠে যায়। উল্লেখ্য, ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দের ১লা জুলাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গানটি প্রকাশিত হয়েছিল।
১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে এই গানটি প্রায় ৪০টি ভাষায় অনূদিত হয়। কিন্তু এই অনূদিত ভাষার তালিকায় বাংলা ছিল না। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে মুজফ্ফর আহমেদ এই গানটির বাংলা অনুবাদের জন্য নজরুল ইসলামকে অনুরোধ করেন। এই বিষয়ে মুজফ্ফর আহমেদ-এর রচিত 'কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা' গ্রন্থে এই বিষয়ে লিখেছেন-
'১৯২৬ সালে আমি নজরুলকে এই গানটি বাঙলায় তর্জমা করতে বলি। তার জন্যে গানের একটি ইংরেজী কপি তো তাকে জোগাড় করে দিতে হবে। চেষ্টা করেও আমি এমন এ্কখানা বই জোগাড় করতে পারলাম না যাতে ব্রিটেনের মজুররা যে তর্জমাটা গান, তা পাওয়া যায়। আমেরিকার তর্জমাটি পাওয়া গেল আপ্টন সিংক্লেয়ারের হেল্(Hell, a Verse Dr a ) নামক নাটিকায়। ব্রিটেনে গাওয়া তর্জমার সঙ্গে দু'টি কিংবা তিনটি শব্দের শুধু তফাৎ। তাতে মানে বদলায়নি, সুর তো নয়ই। আমাদের কেউ তখন ইনটারন্যাশনাল সঙ্গীতের সুর জানতেন না, নজরুলও জানত না। নজরুল আমায় বলল — "এর স্বরলিপি (নোটেশন) জোগাড় করে দাও। তা হলে তা যন্ত্রে বাজিয়ে সেই সুরের চৌহুদ্দীর ভিতরে গানটি আমি তর্জমা করে দেব।" কিন্তু এই নোটেশন আমাদের কেউ দিতে পারলেন না। শেষে নজরুল একদিন আমাদের আফিসে (৩৭, হ্যারিসন রোডে) আসতেই আমি তাকে বললাম — "নোটেশন ছাড়াই তুমি গানটি অনুবাদ করে দাও। প্রথমে একবার তা "গণবাণী"তে ছাপতে দিই, তারপর দেখা যাবে কি করা যায়"। তখনই সেখানে বসেই সে গানটির অনুবাদ করে দিল। বাঙলা ভাষার সর্বোৎকৃষ্ট অনুবাদ তো বটেই, আমার বিশ্বাস ভারতীয় ভাষাগুলিতে যতসব অনুবাদ হয়েছে সে-সবেরও সেরা। বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ হরীন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হিন্দী অনুবাদ দেখেছি, তাঁর মনগড়া কথায় তা ভরা। নজরুলের অনুবাদে তার মনগড়া কথা নেই। তর্জমা করার পরে নজরুল আবারও আমাদের বলে দিল যে তার পরেও যদি আমরা নোটেশন যোগাড় করে দিই তবে সে গানে সুর-সংযোগ করে দেবে। কিন্তু নোটেশন আমরা আর যোগাড় করতে পারলাম না। ১৯২৭ সালে সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ইউরোপ যাওয়ার পরে তাঁকে একটা ছাপানো নোটেশন পাঠানোর জন্যে লিখেছিলেম। তিনি তখন মস্কোতেও ছিলেন। অনায়াসেই আমাদের তা পাঠাতে পারতেন। তা না করে তিনি পাঠালেন তাঁর নিজের একটি অনুবাদ। এটাও আমরা "গণবাণী"তে ছেপেছিলেম। নজরুল কিন্তু তার তর্জমায় সুর-সংযোগ করার সুযোগ আর পায়নি। ১৯২৯ সালে ফিলিপ স্প্রাট যখন বললেন যে তিনিই স্বরলিপি তৈয়ার করে দিবেন (ফিলিপ স্প্রাট গান জানতেন) তখন আমরা তো বহু বৎসরের জন্যে জেলে চলে গেলাম।..."—
মূল ফরাসি কবিতা এবং গান | ইংরেজি অনুবাদ : প্রথম প্রকাশ: The Weekly People, April 26th, 1924. |
Debout, les damnés de la terre Debout, les forçats de la faim La raison tonne en son cratère C'est l'éruption de la fin Du passé faisons table rase Foule esclave, debout, debout Le monde va changer de base Nous ne sommes rien, soyons tout |: C'est la lutte finale Groupons-nous, et demain L'Internationale Sera le genre humain :| Il n'est pas de sauveurs suprêmes Ni Dieu, ni César, ni tribun Producteurs, sauvons-nous nous-mêmes Décrétons le salut commun Pour que le voleur rende gorge Pour tirer l'esprit du cachot Soufflons nous-mêmes notre forge Battons le fer quand il est chaud |: C'est la lutte finale Groupons-nous, et demain L'Internationale Sera le genre humain :| L'État comprime et la loi triche L'impôt saigne le malheureux Nul devoir ne s'impose au riche Le droit du pauvre est un mot creux C'est assez, languir en tutelle L'égalité veut d'autres lois Pas de droits sans devoirs dit-elle Égaux, pas de devoirs sans droits |: C'est la lutte finale Groupons-nous, et demain L'Internationale Sera le genre humain :| Hideux dans leur apothéose Les rois de la mine et du rail Ont-ils jamais fait autre chose Que dévaliser le travail ? Dans les coffres-forts de la bande Ce qu'il a créé s'est fondu En décrétant qu'on le lui rende Le peuple ne veut que son dû. |: C'est la lutte finale Groupons-nous, et demain L'Internationale Sera le genre humain :| Les rois nous saoulaient de fumées |
Stand up, damned of the Earth Stand up, prisoners of starvation Reason thunders in its volcano This is the eruption of the end. Of the past let us make a clean slate Enslaved masses, stand up, stand up. The world is about to change its foundation We are nothing, let us be all. |: This is the final struggle Let us group together, and tomorrow The Internationale Will be the human race. :| There are no supreme saviours |
- গ্রন্থ:
- ফণি মনসা ।
- প্রথম সংস্করণ। শ্রাবণ ১৩৩৪ (জুলাই-আগষ্ট ১৯২৭)। শিরোনাম: অন্তর-ন্যাশনাল সঙ্গীত
- নজরুল রচনাবলী। জন্মশতবর্ষ সংস্করণ, তৃতীয় খণ্ড। বাংলা একাডেমী, ঢাকা। জ্যৈষ্ঠ ১৪১৮, মে ২০১১। ফণী মনসা। শিরোনাম: অন্তর-ন্যাশনাল সঙ্গীত। পৃষ্ঠা: ৬০
- নজরুল গীতিকা
- প্রথম সংস্করণ [ভাদ্র ১৩৩৭ বঙ্গাব্দ। ২ সেপ্টেম্বর ১৯৩০। জাতীয় সঙ্গীত ১০। ইন্টারন্যাশনাল সঙ্গীতের অনুবাদ। পৃষ্ঠা ৩৪]
- নজরুল রচনাবলী, জন্মশতবর্ষ সংস্করণ। তৃতীয় খণ্ড [বাংলা একাডেমী, ঢাকা জুন ২০১২। নজরুল গীতিকা। জাতীয় সঙ্গীত। গান ২৫। ইন্টারন্যাশনাল সঙ্গীতের অনুবাদ। পৃষ্ঠা: ১৮৯--১৯০]
- ফণি মনসা ।
- পত্রিকা: গণবাণী। বৈশাখ ১৩৩৪(এপ্রিল-মে ১৯২৭)
- রেকর্ড: এইচএমভি [এপ্রিল ১৯৪৭ (চৈত্র ১৪৫৩-বৈশাখ ১৩৫৪)] । এন ২৭৬৬৬। শিল্পী: সত্য চৌধুরী।
- সুরকার: নিতাই ঘটক
- স্বরলিপিকার ও স্বরলিপি:
- সুধীন দাশ ও সেলিনা হোসেন। নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপি (৩৭শ খণ্ড)। দ্বিতীয় মুদ্রণ [নজরুল ইন্সটিটিউট। পৌষ, ১৪২১ বঙ্গাব্দ/ জানুয়ারি, ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দ]। ৮ম গান। [নমুনা]
- পর্যায়:
- বিষয়াঙ্গ: কমুনিষ্ট পার্টির আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের অনুবাদ
- সুরাঙ্গ: স্বকীয় বৈশিষ্টের সুর
- তাল: কাহারবা
- গ্রহস্বর: সা