ঘুমাও, ঘুমাও, দেখিতে এসেছি ভাঙাতে আসিনি ঘুম (ghumao, ghumao, dekhite eshechhi vangate ashini ghum)

ঘুমাও, ঘুমাও, দেখিতে এসেছি ভাঙাতে আসিনি ঘুম
কেউ জেগে কাঁদে, কারো চোখে নামে নিদালির মৌসুম॥
            দেখিতে এলাম হ'য়ে কুতূহলী
            চাঁপা-ফুল দিয়ে তৈরি পুতুলী
দেখি, শয্যায় স্তূপ হ'য়ে আছে জোছনার কুম্‌কুম্
আমি নই, ঐ কলঙ্কী চাঁদ নয়নে হেনেছে চুম্॥
রাগ করিও না, অনুরাগ হ'তে রাগ আরো ভালো লাগে,
তৃষ্ণাতুরের কেউ জল চায় কেউ বা শিরাজি মাগে।
            মনে কর, আমি লোলুপ বাতাস
            চোর-জোছনা, ফুলের সুবাস
ভয় নাই, আমি চলে যাই ডাকি' নিশীথিনী নিঃঝুম॥

  • ভাবার্থ: কোনো এক প্রেমিক কোনো এক জ্যোৎস্না-প্লাবিত রাতে সঙ্গোপনে ঘুমন্ত প্রেমিকাকে শুধু দেখার আনন্দেই শিয়রে এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি তাঁর ঘুমন্ত প্রিয়ার অপার রূপসৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ। তারপরেও তিনি তাঁর প্রেমিকার প্রশান্তির ঘুমকে ভাঙাতে চান না। তবু প্রেমিকের মনে অভিমান উথলে উঠে এবং শ্লেষের সাথে স্বগোক্তিতে বলেন- 'কেউ বিরহে জেগে থাকে, কাঁদে- কেউ গভীর ঘুমের তলে থাকে মগ্ন'।

    প্রেমিক তাঁর ঘুমন্ত প্রেমিকার সৌন্দর্য দেখেন অপার কৌতুহলে। তাঁর কাছে মনে হয়- প্রেমিকা কোনো মানবী নয়, যেনো চাঁপা-ফুলের পুতুল, জ্যোৎস্নার কুমকুমে তৈরি তার দেহবল্লরী। সে দেহবল্লরীকে দৃষ্টি-চুম্বন করছে দূরাকাশের চাঁদ। কবির মনে সংশয় জাগে, এই গোপন দর্শনে সে কি কলঙ্কী? পরক্ষণেই প্রেমিক তার কলঙ্কভয়কে দূরাকাশের চাঁদের উপর চাপিয়ে দেন এবং আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেন- স্পর্শ দোষে তিনি দোষী নন, যদি কলঙ্কী হয়ে থাকে সে আকাশের চাঁদ। কবি প্রিয়ার কাছে সবিনয় নিবেদন, তাঁর এই সংগোপন সন্দর্শনে তিনি যেন রাগ না করেন। কবি মনে করেন রাগ থেকে যে অনুরাগের সৃষ্টি হয়, তা রাগের চেয়েও মনোরম।

    গানটির আভোগের 'তৃষ্ণাতুরের কেউ জল চায় কেউ বা শিরাজি মাগে' একটি বিক্ষিপ্ত উদাহরণ। এই পংক্তির মাধ্যমে প্রেমিক বলেন তৃষ্ণার্ত হয়ে কেউ জল প্রার্থনা করে, কেউ বা শিরাজী (ইরান দেশের শিরাজ নগরীর তৈরি মদ, সাধারণ অর্থে মদ) প্রার্থনা করে। প্রেমিকের তৃষ্ণা শিরাজীরূপি প্রিয়ার যৌবনমদ। সঞ্চারীতে প্রেমিকের গোপন প্রিয়াদর্শন শেষে গোপন বিদায়ের অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছে। তার শঙ্কা, এই গোপন দর্শন তাঁর প্রেয়সী হয়তো জেনে গেছে। তাই তাঁর সমাধান হিসেবে- কবি যেন তাঁকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছেন- 'মনে কর, আমি লোলুপ বাতাস/চোর-জোছনা, ফুলের সুবাস'। তারপরেই শঙ্কামুক্ত করার জন্য প্রিয়াকে বলেন- 'ভয় নাই, আমি চলে যাই ডাকি' নিশীথিনী নিঃঝুম '।

    'নজরুল-সংগীত সংগ্রহ' এবং 'গানের মালা' গ্রন্থে গানটির সাথে রাগের নাম পাওয়া যায় মিশ্র জোগিয়া। কিন্তু বেচু দত্তের গাওয়া আদি রেকর্ডে গাওয়া গানের সুর যোগিয়ায় নিবদ্ধ নয়। সম্ভবত আদি সুরটি মিশ্র যোগিয়াতে ছিল। ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে সুধীর দত্তের গাওয়া রেকর্ড এবং ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে  কমল দাশগুপ্তের গাওয়া গানের রেকর্ড কোম্পানি-কর্তৃক বাতিল হয়েছিল। পরে বেচুদত্তের গাওয়া গান যখন রেকর্ড করা হয়, তখন নতুন করে সুর করেছিলেন নিতাই ঘটক। নিতাই ঘটকের সুরটি কোনো নির্দিষ্ট রাগের ছকে বাঁধা নয়। খুঁজলে এতে নানা রাগের আভাষ পাওয়া যায় মাত্র। মূলত বেচু দত্তের গাওয়া নিতাই ঘটকের এই সুরটি, নানা রাগের রঙে সৃষ্ট, যা তাঁর স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের সুর হিসেবে বিবেচনা করা যায়।

     
  • রচনাকাল ও স্থান:  গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর (ভাদ্র-আশ্বিন ১৩৪১) মাসে, এইচএমভি রেকর্ড কোম্পানি রেকর্ড করেছিল। পরে রেকর্ডটি বাতিল হয়ে যায়। এই সময় নজরুলের বয়স ৩৫ বৎসর ছিল ৩ মাস।
  • গ্রন্থ:
    • গানের মালা
      • প্রথম সংস্করণ আশ্বিন ১৩৪১ বঙ্গাব্দ (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দ)। ৬১। যোগিয়া মিশ্র-দাদরা
      • নজরুল রচনাবলী। জন্মশতবর্ষ সংকলন ষষ্ঠ খণ্ড। বাংলা একাডেমী, ঢাকা। জ্যৈষ্ঠ ১৪১৯, জুন ২০১২। গানের মালা। ৬১। যোগিয়া মিশ্র-দাদরা। পৃষ্ঠা ২২৮- ২২৯]
    • নজরুল গীতি, অখণ্ড
      • প্রথম সংস্করণ [আব্দুল আজীজ আল-আমান সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। ৬ আশ্বিন ১৩৮৫। ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮]
      • দ্বিতীয় সংস্করণ [আব্দুল আজীজ আল-আমান সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। ১ শ্রাবণ ১৩৮৮। ১৭ জুলাই ১৯৮১]
      • তৃতীয় সংস্করণ [ব্রহ্মমোহন ঠাকুর সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। ৮ মাঘ ১৪১০। ২৩ জানুয়ারি ২০০৪। কাব্য-গীতি। ২৭২ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা ৭২-৭৩]
      • পরিবর্ধিত সংস্করণ [আব্দুল আজীজ আল-আমান সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। বৈশাখ শ্রাবণ ১৪১৩। এপ্রিল-মে ২০০৬] ২৭৫ সংখ্যাক গান। পৃষ্ঠা: ৫৪।
    • নজরুল-সংগীত সংগ্রহ [রশিদুন্ নবী সম্পাদিত। কবি নজরুল ইন্সটিটিউট। তৃতীয় সংস্করণ দ্বিতীয় মুদ্রণ, আষাঢ় ১৪২৫। জুন ২০১৮] গান ৫। পৃষ্ঠা ২
    • নজরুল-সঙ্গীত স্বরলিপি প্রথম খণ্ড। প্রথম প্রকাশ, তৃতীয় মুদ্রণ [নজরুল ইন্সটিটিউট। অগ্রহায়ণ ১৪০২। নভেম্বর ১৯৯৫। ৫ সংখ্যক গান] পৃষ্ঠা ৩৯-৪৩] [নিতাই ঘটকের সুরে]
  • রেকর্ড:
    • এইচএমভি  [সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ (ভাদ্র-আশ্বিন ১৩৪১)। শিল্পী: সুধীর দত্ত। রেকর্ডটি বাতিল হয়ে গিয়েছিল।
    • এইচএমভি  [অক্টোবর ১৯৩৫ (আশ্বিন-কার্তিক ১৩৪২)। শিল্পী: কমল দাশগুপ্ত । রেকর্ডটি বাতিল হয়ে গিয়েছিল।
    • এইচএমভি [সেক্টোবর ১৯৪৯ (ভাদ্র-আশ্বিন ১৩৫৬)। শিল্পী: বেচু দত্ত। এন ৩১১০৪। সুর নিতাই ঘটক] [শ্রবণ নমুনা]
       
  • রেকর্ড:
    • এইচএমভি  [সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ (ভাদ্র-আশ্বিন ১৩৪১)। শিল্পী: সুধীর দত্ত। রেকর্ডটি বাতিল হয়ে গিয়েছিল।
    • এইচএমভি  [অক্টোবর ১৯৩৫ (আশ্বিন-কার্তিক ১৩৪২)। শিল্পী: কমল দাশগুপ্ত । রেকর্ডটি বাতিল হয়ে গিয়েছিল।
    • এইচএমভি [সেক্টোবর ১৯৪৯ (ভাদ্র-আশ্বিন ১৩৫৬)। শিল্পী: বেচু দত্ত। এন ৩১১০৪। সুর নিতাই ঘটক] [শ্রবণ নমুনা]
       
  • সুরকার: নিতাই ঘটক। [নজরুল-সঙ্গীত স্বরলিপি, প্রথম খণ্ড (কবি নজরুল ইন্সটিটিউট)। পৃষ্ঠা ৩৯]
  • স্বরলিপিকার ও স্বরলিপি: সুধীন দাশ। নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপি (প্রথম খণ্ড)। প্রথম প্রকাশ, তৃতীয় মুদ্রণ [কবি নজরুল ইন্সটিটিউট। অগ্রহায়ণ ১৪০২। নভেম্বর ১৯৯৫। পঞ্চম গান] [ নমুনা]
  • পর্যায়:
    • বিষয়াঙ্গ: প্রেম
    • সুরাঙ্গ: স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের সুর ।
      • রাগ: যোগিয়া মিশ্র।
        • [নজরুল-সংগীত সংগ্রহ (রশিদুন্‌ নবী সম্পাদিত। কবি নজরুল ইন্সটিটিউট)। পৃষ্ঠা ২]
        • [গানের মালা। নজরুল-রচনাবলী─ষষ্ঠ খণ্ড (বাংলা একাডেমী)। পৃষ্ঠা ২২৮]

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।