তোমার বিনা-তারের গীতি বাজে আমার বীণা-তারে (tomar bina tarer giti baje amar bina-tare)

তোমার বিনা-তারের গীতি বাজে আমার বীণা-তারে
রইল তোমার ছন্দ-গাথা গাঁথা আমার কণ্ঠ-হারে॥
কি কহিতে চাও হে গুণী, আমি জানি আমি শুনি
কান পেতে রই তারার সাথে তাই তো দূর গগন-পারে॥
পালিয়ে বেড়াও উদাস হাওয়া গোপন কথার ফুল ফুটিয়ে গো
আমি তারে মালা গেঁথে লুকিয়ে রাখি বক্ষে নিয়ে গো।
হয়তো তোমার কথার মালা, কাঁটার মত করবে জ্বালা
সেই জ্বালাতেই জ্বলবে আমার প্রেমের শিখা অন্ধকারে॥

  • ভাবসন্ধান: আকাশবাণী কলকাতার ত্রয়োদশ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে কাজী নজরুল ইসলাম 'আকাশবাণী' নামক একটি 'গীতি-আলেখ্য' রচনা করেন। এ গানের বিনা-তার হলো বেতার। আর বীণা-তার কবির মনোবীণার তার। 'আকাশবাণী' অনুষ্ঠানের জন্য রচিত বলে একে আনুষ্ঠানিক পর্যায়ে ফেলা যেতে পারে। কিন্তু এই অনুষ্ঠানের গণ্ডির বাইরে এসে বলা যায় এটি একটি নিটল প্রেমের গান।

    এই গানের স্থায়ীতে সাধারণভাবে দেখা যায়- কোনো এক শিল্পীর বিনা-তারের সঙ্গীত, কবির হৃদয় বীণার অনাহত নাদকে জাগ্রত করে দেয়। কবি বিনা-তারের মহিমায়, নাকি শিল্পীর সঙ্গীতের নান্দনিক অভিঘাতের মুগ্ধতা, এ নিয়ে দ্বন্দ্ব থেকেই যায়। এই গানের 'তুমি' কে? বেতার বা শিল্পী যেই হোক না। মোট কথা, আকাশবাণীর বেতার তরঙ্গের (বিনা-তার) মাধ্যমে যে মধুর সঙ্গীত ছড়িয়ে পড়ে, তার অভিঘাতে অনুরাগী শ্রোতার হৃদয়-বীণার তার ঝঙ্কৃত হয়। যেন ফুলের মতো সে আনন্দময় ছন্দ-গাথা (ছন্দের পালা) বাণী-সুরের সমন্বয়ে গ্রথিত হয়ে, মুগ্ধ শ্রোতার কণ্ঠ-হার হয়ে বিরাজ করে।

    স্থায়ীর সুরের চলনেও রয়েছে ছন্দের-পালা বদল। গানের স্থায়ীর প্রথম পঙ্‌ক্তিতে ত্রিতালের ছন্দে রয়েছে প্রথাগত খেয়ালের ঢং।  এই অংশে ছন্দ চলে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে। কিন্তু ছন্দের পালা বদলে যায় দ্বিতীয় পঙ্‌ক্তিতে। 'রইল তোমার ছন্দ-গাথা' অংশ দুলে দুলে চলে। যেন ছন্দের দোলায় বাণীর ডিঙি দোল খায়। এই দোলা 'কণ্ঠহারে' আবর্তিত হয়ে স্থায়ীতে ফিরে আসে। এর ভিতর দিয়ে কথা ও সুরের ফুলগুলো দিয়ে ছন্দের গাথাটি সম্পন্ন হয় এবং মালা-গাঁথা শেষ হয়।

    স্থায়ীর দ্ব্যর্থ উপস্থানার আবেশ থেকে বেরিয়ে এসে গানটি যখন অন্তরাতে পৌঁছায়- তখন মনে হয় এই গানের তুমি বেতার নয়, কোনো এক গুণী শিল্পী। এই শিল্পী গানের সুরের কি কথা শুনাতে চান অনুরাগী ভক্ত তা জানেন। দূর আকাশের তারাদের মতোই বেতারের গান শোনার জন্য এই অনুরাগী উন্মুখ হয়ে থাকেন।

    সঞ্চারীতে পাওয়া যায়, বিনা-তারের গানের ভিন্ন রূপ। বেতারে শব্দ তরঙ্গ, কোনো বিশেষ লক্ষ্যস্থলের জন্য সম্প্রাচারিত  হয় না। তাই বেতারে শব্দতরঙ্গ যেন উদাসী হওয়ার মতো। বেতারগ্রাহক যন্ত্রে সেই উদাসী শব্দতরঙ্গ ধৃত হয়ে বাঙময় হয়ে ওঠে। বিনা-তারে গীত গানও সুর-বাণী-ছন্দে গ্রথিত হয়ে উদাসী হাওয়ার মতো পালিয়ে বেড়ায়। উদাসী সুরের দোলার ভিতর থকে অনুরাগী শ্রোতা বাণীর গোপন বার্তা খুঁজে পান এবং সংগোপন নিজের মনের গোপন কোঠায় লুকিয়ে রাখেন।  সঞ্চারীর এই অংশে শুধু ছন্দের পালা-বদল হয় না, সুরাঙ্গও বদলে যায়। খাম্বাজ রাগাঙ্গের চলনে আসে পরিবর্তন। 'পালিয়ে বেড়াও গোপন কথা ' রাগাঙ্গ ছেড়ে বেরিয়ে এসে ভাটিয়ালি সুরাঙ্গের আবেশ ছড়িয়ে দেয়। 'ফুল ফুটিয়ে গো'- তে এসে, সুর যেন খাম্বাজের নিজ ঘরে ফিরে আসে।

    আভোগে ফুটে ওঠে অনুরাগী শ্রোতার প্রেমের গভীর আনন্দ-বিরহ খেলার দ্বন্দ্ব। এই শ্রোতা তার অনুরাগের খোলস ড়েছে বেড়িয়ে এসে প্রেমিক হয়ে যায়। এই প্রেমিকের সংশয় জাগে। বিনাতারের অভিঘাতে যে মোহ জন্মেছিল প্রেমিকের মনে, মনের বীণায় ছড়িয়ে পড়েছিল প্রেমের মোহময় আবেশ। তার পরিণতি কি, এই নিয়েই এই সংশয়। সংশয়, গানের সুর-বাণী হয়তো অনুরাগীর হৃদয়ে প্রেমবিদগ্ধ কাঁটার মতো কি বিদ্ধ করবে!? হয়তো তা করবে। অনুরাগী প্রত্যাশা করেন, হয়তো  এই কণ্টক-জ্বালার মধ্য দিয়ে তাঁর প্রেমহীন অন্ধকার হৃদয়পটৈ, প্রেমের প্রদীপ জ্বলে উঠবে। এই গানের শেষাংশ এসে গানটি শুধুই বেতারের গান না হয়ে একাটি নিটল প্রেমের গান হয়ে উঠেছে।

     
  • রচনাকাল ও স্থান: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ২৬শে আগষ্ট (মঙ্গলবার ১০ ভাদ্র ১৩৪৭) আকাশবাণী কলকাতার ত্রয়োদশ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে কাজী নজরুল ইসলাম 'আকাশবাণী' নামক একটি 'গীতি-আলেখ্য' রচনা করেন। এই গীতি-আলেখ্যের জন্যই নজরুল এই গানটি  রচনা করেছিলেন। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ৪১ বৎসর ২ মাস।
  • গ্রন্থ:
    • অগ্রন্থিত গান নজরুল-রচনাবলী─দশম খণ্ড [নজরুল জন্মশতবর্ষ সংস্করণ। বাংলা একাডেমী, জ্যৈষ্ঠ ১৪১৬। মে ২০০৯। ২৩৮ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা ৩২২-৩২৩]
    • নজরুল গীতি, অখণ্ড
      • প্রথম সংস্করণ [আব্দুল আজীজ আল-আমান সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। ৬ আশ্বিন ১৩৮৫। ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮]
      • দ্বিতীয় সংস্করণ [আব্দুল আজীজ আল-আমান সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। ১ শ্রাবণ ১৩৮৮। ১৭ জুলাই ১৯৮১]
      • তৃতীয় সংস্করণ [ব্রহ্মমোহন ঠাকুর সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। ৮ মাঘ ১৪১০। ২৩ জানুয়ারি ২০০৪। কাব্য-গীতি। ৩৭৭ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা ৯৮]
      • পরিবর্ধিত সংস্করণ [আব্দুল আজীজ আল-আমান সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। বৈশাখ শ্রাবণ ১৪১৩। এপ্রিল-মে ২০০৬] ভৈরবী-গজল। ৩৮২ সংখ্যাক গান। পৃষ্ঠা: ৭৩।
    • নজরুল-সংগীত সংগ্রহ [রশিদুন্ নবী সম্পাদিত। কবি নজরুল ইন্সটিটিউট। তৃতীয় সংস্করণ দ্বিতীয় মুদ্রণ, আষাঢ় ১৪২৫। জুন ২০১৮। গান ৪৩। পৃষ্ঠা ১৪]
    • নজরুল-সঙ্গীত স্বরলিপি, দ্বিতীয় খণ্ড। প্রথম প্রকাশ, দ্বিতীয় মুদ্রণ [কবি নজরুল ইন্সটিটিউট। পৌষ ১৪০২। ডিসেম্বর ১৯৯৫। ১৮ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা ৯২-৯৪]
  • পত্রিকা: বেতার জগৎ। বেতার জগৎ। ১১শ বর্ষ ১৭শ সংখ্যা। শিরোনাম: আকাশ-বাণীর গান। গান সংখ্যা ৪। পৃষ্ঠা: ২০।
     
  •  বেতার: আকাশবাণী (গীতিকা)
    • প্রথম প্রচার: ২৬ আগষ্ট, ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দ (মঙ্গলবার ১০ ভাদ্র ১৩৪৭)। কলকাতার খ। চতুর্থ অধিবেশন। সন্ধ্যা ৭.৪৫ থেকে ৮.২৯ মিনিট।
      • সূত্র:
        • বেতার জগৎ। ১১শ বর্ষ ১৬শ সংখ্যা। পৃষ্ঠা: ৮৮৪
        • The Indian-listener 1940, Vol V, No 16. page 1253
    • দ্বিতীয় প্রচার: ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দ (শনিবার ৯ ফাল্গুন ১৩৪৮)। কলকাতার খ। চতুর্থ অধিবেশন। সন্ধ্যা ৭.৩০ থেকে ৮.০৯।
      • সূত্র: The Indian-listener 1942, Vol VII, No 4. page 51]
         
  • রেকর্ড: এইচএমভি । জানুয়ারি ১৯৪২ । (পৌষ-মাঘ ১৩৪৮) এন ২৭২৩৩। কুমারী ইলা ঘোষ
     
  • সুরকার: কাজী নজরুল ইসলাম।
  • স্বরলিপি ও স্বরলিপিকার: সুধীন দাশ নজরুল-সঙ্গীত স্বরলিপি, দ্বিতীয় খণ্ড। কবি নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা। দ্বিতীয় মুদ্রণ। পৌষ, ১৪০২ বঙ্গাব্দ/ ডিসেম্বর ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দ।][নমুনা]
     
  • পর্যায়:

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।