এসো এসো এসো ওগো মরণ (esho esho esho ogo moron)

             এসো এসো এসো ওগো মরণ!
এই        মরণ-ভীতু মানুষ-মেষের ভয় করে গো হরণ॥
             না বেরিয়েই পথে যা'রা পথের ভয়ে ঘরে
            বন্ধ-করা অন্ধকারে মরার আগেই মরে,
তাতা     থৈ থৈ তাতা থৈ থৈ তাদের বুকের 'পরে-
ভীম      রুদ্রতালে নাচুক তোমার ভাঙন-ভরা চরণ॥
                    দীপক রাগে বাজাও জীবন-বাঁশি
                    মড়ার মুখেও আগুন উঠুক হাসি'।
            কাঁদে পিঠে কাঁদে যথা শিকল জুতোর ছাপ
            নাই সেখানে মানুষ সেথা বাঁচাও মহাপাপ,
সে        দেশের বুকে শ্মাশান মশান জ্বালুক তোমার শাপ,
সেথা     জাগুক নবীন সৃষ্টি অবার হোক নব নাম-করণ॥
                     হাতের তোমার দণ্ড উঠুক কেঁপে',
                    এবার দাসের ভুবন ভবন ব্যেপে'।
            মেষগুলোকে শেষ ক'রে দেশ-চিতার বুকে নাচো!
            শব ক'রে আজ শয়ন, হে শিব, জানাও তুমি আছ।
            মরায় ভরা ধরায়, মরণ! তুমিই শুধু বাঁচো-
এই       শেষের মাঝেই অশেষ তুমি, করছি তোমায় বরণ॥
                    জ্ঞান-বুড়ো ঐ বলছে জীবন মায়া,
                    নাশ কর ঐ ভীরুর কায়া ছায়া!
            মুক্তি-দাতা মরণ! এসো কাল-বোশেখির বেশে;
            মরার আগেই মরলো যারা, নাও তাদের এসে।
            জীবন তুমি সৃষ্টি তুমি জরা-মরার দেশে,
তাই     শিকল বিকল মাগ্‌ছে তোমার মরণ-হরণ-শরণ॥

  • ভাবসন্ধান: বৈদিক যুগে রুদ্রের দুটি রূপের উল্লেখ পাওয়া যায়। এর একটি সৃষ্টির ধ্বংস, অপরটি সৃষ্টির কল্যাণ। এই গানটিতে রুদ্ররূপী শিবের এই দ্বৈত সত্তাকে আহ্বান করা হয়েছে- ধ্বংস ও ‌নবসৃষ্টির জন্য।

    গানটির স্থায়ীতে রুদ্ররূপী শিবকে ধ্বংসর দেবতা হিসেবে মরণ সম্বোধন করার পাশাপাশি। মরণ-ভীতু মেষের মতো মানুষের সকল ভয়কে হরণ করে কল্যাণের প্রতিষ্ঠার জন্য আহ্বান করা হয়েছে।  যারা চলার পথের দুর্ভোগের ভয়ে ঘরেই বসে থাকে। মুক্তির কথা না ভেবে যারা বন্ধ-করা অন্ধকারে মরার আগেই মরে, তাদের ধ্বংস করে নব সৃষ্টির জন্য শিবকে আহ্বান করা হয়েছে। কল্যাণময় নবসৃষ্টির জন্য শিবকে আবাহন করা হয়েছে- ধ্বংসের তাণ্ডব নৃ্ত্যের 'তাতা থৈ থৈ তাতা থৈ থৈ' ছন্দে। ভীম ও রুদ্রতালে (সঙ্গীতশাস্ত্রের দুটি তাল) তাঁর ধ্বংসের তাণ্ডবনৃত্য প্রলয়ঙ্করী হয়ে উঠুক। অগ্নিবর্ষী দীপক রাগে শিবের ধ্বংস-মহিমা বেজে উঠুক নব-জীবনদায়ী বাঁশীতে। সে সুর-বাণী- ছন্দে মৃতের মুখে জ্বলে উঠুক জীবনের হাসির আগুন।

    যেখানে অমানুষের পায়ের তলে নিষ্পেষিত হয় মানুষ। সেখানে মানুষের নামে বেঁচে থাকাও পাপ। এরূপে দেশের বুকে শ্মাশান মশান জ্বলুক শিবের অভিশাপে। আবার তাঁরই মহিমায় সেখানে জেগে উঠুক নব নামে নবীন সৃষ্টি। এই ধ্বংসযজ্ঞে তাঁর শাসন দণ্ড কম্পিত হোক, দাসত্বের শৃঙ্খলে বাধা জগতসংসার। মরণভয়ে ভীতু মেষদের বিনাশ করে দেশ-চিতার বুকে নাচুক রু্দ্ররূপী শিব। এ সবের মধ্য দিয়ে অত্যাচারী আর নির্যাতিতরা জানুক শিব আছেন। মরায় ভরা এই পৃথিবীর মরণ হয়ে একমাত্র শিব অমর হয়ে থাকুক। সব কিছুর শেষের মাঝে শিব বিরাজ করুক অশেষ রূপে।

    ভীরু মানুষের  জীবনের মায়া, কায়া ও ছায়া সবই ধ্বংস করার জন্য বলেছেন জ্ঞান-বুড়োকে (শিব)। সবশেষে শিবকে আবাহন করা হয়েছে- মুক্তি দাতা মরণ হিসেবে। তিনি যেন আসেন  কাল-বোশেখির বেশে। তিনি যেন মরার আগেই যার মরে, তাদেরকে ধ্বংস করে- মরার দেশে নতুন জীবন সৃষ্টি করেন। বন্দীত্বের শিকল, অত্যাচারে যারা বিকল, তারা সবাই প্রার্থনা করছে- শিবের এই মৃত্যুযজ্ঞ, অকল্যাণের হরণ এবং সবশেষে তাঁরই আনুকূল্য।

     
  • রচনাকাল: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। গানটি 'বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা'র 'কার্তিক ১৩২৮' অক্টোবর-নভেম্বর ১৯২১  সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। ধারণা করা হয়, গানটি আশ্বিন মাসে রচিত হয়েছিল। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ২২ বৎসর ৫ মাস।
     
  • পত্রিকা:
  • গ্রন্থ: 
    •  বিষের বাঁশী'
      • প্রথম সংস্করণ [১৬ই শ্রাবণ ১৩৩১ বঙ্গাব্দ (শুক্রবার ১ আগষ্ট ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দ)। শিরোনাম: মরণ-বরণ]
      • নজরুল রচনাবলী। জন্মশতবর্ষ সংকলন প্রথম খণ্ড। বাংলা একাডেমী, ঢাকা। জ্যৈষ্ঠ ১৪১৩, মে ২০০৬। শিরোনাম: মরণ-বরণ। গান। পৃষ্ঠা: ১২৩-১২৪।
    • নজরুল-সঙ্গীত সংগ্রহ,[নজরুল ইনস্টিটিউট, মাঘ ১৪১৮। ফেব্রুয়ারি ২০১২। সংখ্যা ২২৯৮]
  • স্বরলিপি ও স্বরলিপিকার:
  • সুরকার: কাজী নজরুল ইসলাম
  • পর্যায়:
    • বিষয়াঙ্গ: ধর্মসঙ্গীত। সনাতন হিন্দুধর্ম। শাক্ত। শিব। ধ্বংস ও কল্যাণ
    • সুরাঙ্গ: স্বকীয় বৈশিষ্ট্য

 

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।