দুরন্ত বায়ু পূরবইয়াঁ বহে অধীর আনন্দে (duronto bayu purbaiya bohe odhir anonde)

দুরন্ত বায়ু পূরবইয়াঁ বহে অধীর আনন্দে।
তরঙ্গে দুলে আজি নাইয়াঁ রণ-তুরঙ্গ-ছন্দে॥

অশান্ত অম্বর-মাঝে মৃদঙ্গ গুরুগুরু বাজে,
আতঙ্কে থরথর অঙ্গ মন অনন্তে বন্দে॥

ভূজঙ্গী দামিনীর দাহে দিগন্ত শিহরিয়া চাহে,
বিষন্ন ভয়-ভীতা যামিনী খোঁজে সেতারা চন্দে॥

মালঞ্চে এ কি ফুল-খেলা,  আনন্দে ফোটে যূথী বেলা,
কুরঙ্গী নাচে শিখী-সঙ্গে মাতি' কদম্ব-গন্ধে।।

একান্তে তরুণী তমালী অপাঙ্গে মাখে আজি কালি,
বনান্তে বাঁধা প'ল দেয়া কেয়া-বেণীর বন্ধে।।

দিনান্তে বসি' কবি একা, পড়িস কি জলধারা-লেখা
হিয়ায় কি কাঁদে কুহু-কেকা, আজি অশান্ত দ্বন্দ্বে।।

  • ভাবসন্ধান: এক কথায় বলা যায়, এই গানটি বাণী ও সুরের মেলবন্ধনে বর্ষার এক চিত্রময় রূপ তৈরি করেছে। নানা উপমায়, নানা রূপকল্পের ভিতর দিয়ে কবি এই গানে- বর্ষার রূপ তুলে এনেছেন নিপুণ চিত্রকরের মতো।

    বর্ষার প্রবল বায়ু বারিধারা বুকে নিয়ে অধীর আনন্দে প্রবাহিত হচ্ছে। যোদ্ধা ঘোড়া যেমন রণক্ষেত্রে ছুটে চলে, তেমনি যেন নদীর ঢেউয়ের সাথে যুদ্ধ করে মেঘের নৌকা ছুটে চলেছে। আকাশের মেঘমালায় বাজছে মৃদঙ্গের গুরুগুরু ধ্বনি। সেই মেঘনাদের শব্দে আতঙ্কে থরথর করে কাঁপছে দেহ-মন। আকাশে সাপের মতো বিদ্যুৎরেখার প্রাবল্যে দিগন্ত ভয়ে শিহরিত। আলোহীন অন্ধকার রাত্রিও যেন ভয় পেয়ে, আলোর আশায় আকাশের চন্দ্র-তারকার খোঁজ করছে। আবার এরই ভিতরে আনন্দের খেলায় মেতে উঠেছে বর্ষার ফুল- যূথী, বেলি। আর কদম্বের গন্ধে হরিণী নেচে ওঠে ময়ূরের সাথে। কবি নতুন ভাবে অনুভব করেন যেন- নিভৃতে তমাল তরুণী বিরহিনী হয়ে কাঁদছে। তার চোখে যেন বেদনার কালি। এইভাবে বাধা পড়েছে বনবনান্তে বরষা, প্রেমিকা কেয়া তরুণীর বেণীর ফাঁদে।

    সবশেষ কবি ফিরে আসেন নিজের ভুবনে। সেখানে তিনি এমন বর্ষায়, নিজের চাওয়া-পাওয়ার খুঁজে পেতে চেয়েছেন অবিরাম জলধারার গল্পকথা। সেখানে তিনি অনুভব করেন পাওয়া না পাওয়ার দ্বন্দ্ব। মনের চলে বিরহী কোকিলের কুহ আর ময়ূরীর প্রেমঘন কেকা ধ্বনি। কবি অশান্ত বর্ষার রূপ দেখতে পান, নিজের মনের গভীরে। এই তাঁর মন আর প্রকৃতির রূপ একাকার হয়ে গেছে শেষের দুটি পঙ্‌ক্তিতে।

     
  • রচনাকাল ও স্থান: কল্লোল পত্রিকার 'জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৪ (মে- জুন ১৯২৭)' সংখ্যায় প্রকাশিত গানটির সাথে রচনার স্থান ও তারিখ উল্লেখ আছে- 'কৃষ্ণনগর, ১ পৌষ ১৩৩৩' [(রবিবার ১৬ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার ১৯২৬)]। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ২৭ বৎসর ৭ মাস।

    গানটির পাদটীকায় উল্লেখ ছিল-  'উর্দু গজল নাজ্‌ভি হোতা রহে হোতি রহে বে-দাদ্-ভি'-সুর। উল্লেখ্য, ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণে মিশরের নৃত্যশিল্পী মিস্ ফরিদা কলকাতার আলফ্রেড রঙ্গমঞ্চে নৃত্য পরিবেশন করতে এসেছিলেন। সেই নৃত্যানুষ্ঠান নজরুল দেখেছিলেন। উক্ত অনুষ্ঠানর শ্রুত উর্দু গজলের সুরে তিনি এই গানটি রচনা করেছিলেন।

    উল্লেখ্য ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ ডিসেম্বরে অসুস্থ অবস্থায় তিনি কৃষ্ণনগরে ছিলেন। ২৬শে ডিসেম্বর (রবিবার, ১১ পৌষ ১৩৩৩) নজরুল কৃষ্ণনগর থেকে মুরলীধর বসুকে লেখা থেকে জানা যায়, নজরুল অসুস্থ অবস্থায় উর্দু গজলের সুরে কয়েকটি বাংলা গজল রচনা করেছিলেন। এ সকল গজলের ভিতরে এই গানটি ছিল। গানটির পাদটীকায় উল্লেখ ছিল-  'উর্দু গজল নাজ্‌ভি হোতা রহে হোতি রহে বে-দাদ্-ভি'-সুর। উল্লেখ্য, ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণে মিশরের নৃত্যশিল্পী মিস্ ফরিদা কলকাতার আলফ্রেড রঙ্গমঞ্চে নৃত্য পরিবেশন করতে এসেছিলেন। সেই নৃত্যানুষ্ঠান নজরুল দেখেছিলেন। উক্ত অনুষ্ঠানর শ্রুত উর্দু গজলের সুরে তিনি এই গানটি রচনা করেছিলেন।

     
  • পত্রিকা:
    • সওগাতফাল্গুন ১৩৩৩ (ফেব্রুয়ারি-মার্চ ১৯২৭)
    • কল্লোল জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৪ (মে-জুন ১৯২৭)।
  • গ্রন্থ:
    • বুলবুল
      • নভেম্বর ১৯২৮। কার্তিক ১৩৩৫। কাফি-সিন্ধু-কাহারবা। গান ১১
      • নজরুল-রচনাবলী, জন্মশতবর্ষ সংস্করণ। দ্বিতীয় খণ্ড [বাংলা একাডেমী, ফাল্গুন ১৪১৩। ফেব্রুয়ারি ২০০৭। বুলবুল। গান ১১। ভীমপলশ্রী-দাদরা। পৃষ্ঠা: ১৫৯।
    • নজরুল-গীতিকা
      • প্রথম সংস্করণ: সেপ্টেম্বর ১৯৩০। ভাদ্র ১৩৩৭। কাফি-সিন্ধু-কাহারবা। গজল। ১৭। পৃষ্ঠা: ৭৬
      • নজরুল রচনাবলী, জন্মশতবর্ষ সংস্করণ। তৃতীয় খণ্ড [বাংলা একাডেমী, ঢাকা জুন ২০১২। নজরুল গীতিকা।  ৬২। গজল। কাফি-সিন্ধু-কাহারবা। পৃষ্ঠা: ২১৩]

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।