দোলন-চাঁপা বনে দোলে দোল্-পূর্ণিমা-রাতে চাঁদের সাথে (dolon-chapa bone dole)
দোলন-চাঁপা বনে দোলে দোল্-পূর্ণিমা-রাতে চাঁদের সাথে।
(শ্যাম) পল্লব-কোলে যেন দোলে রাধা লতার দোলনাতে॥
(যেন) দেব-কুমারীর শুভ্র হাসি
ফুল হয়ে দোলে ধরায় আসি'
আরতির মৃদু জ্যোতি প্রদীপ-কলি দোলে যেন দেউল-আঙিনাতে॥
বন-দেবীর ওকি রূপালী ঝুম্কা চৈতি সমীরণে দোলে,
রাতের সলাজ আঁখি-তারা যেন তিমির-আঁচলে।
ও যেন মুঠিভরা চন্দন-গন্ধ
দোলে রে গোপিনীর গোপন আনন্দ,
ও কি রে চুরি করা শ্যামের নূপুর, চন্দ্রা-যামিনীর মোহন হাতে॥
- ভাবসন্ধান: গানটি নজরুল রচিত 'নব রাগমালিকা' গীতিনাট্যের প্রথম অনুষ্ঠানের দোলন-চাঁপা রাগে ষষ্ঠ গান। 'বেতার জগত'-এ প্রকাশিত এই গানটির শুরুতে, নজরুল ইসলাম কবিতায় 'দোলানচাঁপা রাগের প্রকৃতি বর্ণনা করেছেন এই ভাবে-
ফিরে আসিল না আর বনের কিশোর
ঘরে ফিরিল না আর বনের কিশোরী
মাধুরী চাঁদের বুকে কৃষ্ণ লেখা হয়ে
দেখা দেয় আজো সেই কিশোরের ছায়া।
কাঁদে চাঁদ সেই বিরহীরে বুকে ধরি
আনন্দে কলঙ্কী নাম করিল বরণ।
বনের কিশোরী চন্দ্রা সেই চাঁদ পানে
চাহিয়া বনের বুকে বিসরিয়া তনু
ধরিল দোলনচম্পা রূপ এ ধরায়
জনম লভিয়া পুন হেরিতে কিশোর।
আজো দোল পূর্ণিমার রাতে বিকশিয়া
ঝরে যায় বিরহের প্রখর বৈশাখে
বারে বারে জন্ম লভে মরে বারে বারে
তবু তার প্রেমের সে অনন্ত পিপাসা
মিটিল না মিটিবে না বুঝি কোন কালে
অনন্ত এ বিরহের রাস মঞ্চে তার
অচ্ছেদ্য মিলন লীলা চলে অনিবার॥
গানটির সাথে রাগের আরোহ-অবরোহ, বাদী, সম্বাদী উল্লেখের সাথে সাথে রাগের প্রকৃতি বর্ণিত হয়েছে, এই ভাবে-
'ইহাতে হাম্বীর, কামোদ ও নট রূপ মাঝে মাঝে উঁকি দেয়, কিন্তু ইহার গতি অত্যন্ত দোলনশীল বলিয়া ঐসব রাগের আভাস দিয়াই ছুটিয়া পালাইয়া যায়। আরোহণে পূর্ববর্তী সুরকে ধরিয়া 'ঝুলনা' বা দোলাই ইহার প্রধান বিশেষণ, দক্ষিণ সমীরণে দোলনচাঁপার দোলনের সঙ্গে ইহার গতির সামঞ্জস্য হইতে ইহার নাম দোলনচাঁপা হইয়াছে। তীব্র মধ্যম ও গা মা না ধা-র চাঁপা ফুলের সুরভির তীব্রতা ও মাধুর্য ফুটিয়া উঠে।'
নব রাগমালিকার অন্যান্য গানের মতোই এই গানটিও 'দোলনচাঁপা' রাগের রূপক-লক্ষণগীত। এরপরেও এই গানে একটি স্বতন্ত্র অর্থ পাওয়া যায়। এর সরলার্থ হলো-
দোলনচাঁপা সকল আনন্দের এক অনির্বচনীয় সৌন্দর্যের তরঙ্গ। দোলন-চাঁপা রাগের অপরূপ দোল- যা হাম্বীর, কামোদ ও নট-এর রূপকে ভাগিয়ে দিয়ে আপন মহিমায় দুলে উঠে আপন মহিমায়। এই দোলনের আনন্দই এই গানের মূল সৌন্দর্য।
গানের স্থায়ীতে দোলনের আনন্দকে কবি দেখাতে চেয়েছেন- যেনো, দোল্-পূর্ণিমারাতে চাঁদের সাথে দোলন-চাঁপা ফুল দোল খায়। দোল-পূর্ণিমায় শ্যামের সাথে রাধা যেমন দোলনায় দোলে, তেমনি দোলন-চাঁপাও সবুজ-পাতার কোলে লতার দোলনাতে দোলে।
দেব-কুমারীর নির্মল হাসিই যেন দোলন-চাঁপা ফুল হয়ে পৃথিবীতে এসে দোলা খায়। যেন পূজার আরতি-প্রদীপের মৃদু জ্যোতি ফুলের কলির মতো মন্দিরের আঙিনাতে দোলে।
কবি দোলন-চাঁপার রূপে মুগ্ধ। তিনি ভাবেন বনদেবীর কানের দুলই যেনো চৈতালি চাদনী রাতে রূপালী ঝুমকা হয়ে দুলছে, যেন রাতের গোপন আনন্দের সলাজ আঁখিতারা অন্ধকারের আবরণের ভিতর দিয়ে আনন্দতরঙ্গে দুলছে।
দোলন চাঁপায় যেনো একমুঠি চন্দনের গন্ধের মতো, যা গোপিনীর গোপন আনন্দে দোলে। চন্দ্রশোভিত রাত্রিতে যেন মন চুরি করা শ্যামের নূপুর ধ্বনির ছন্দ, গোপিনীকে আন্দোলিত করে।
- রচনাকাল ও স্থান: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ জানুয়ারি, (সোমবার ২৯ পৌষ ১৯৪৭) সন্ধ্যা ৭.২০টায় কলকাতা বেতারকেন্দ্র থেকে নজরুল-সৃষ্ট রাগ নিয়ে তৈরি 'নব রাগমালিকা' গীতিনাট্যের প্রথম পর্ব প্রচারিত হয়েছিল। এই গানটি ছিল গীতিনাট্যের ষষ্ঠ গান। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ৪০ বৎসর ৭ মাস।
- গ্রন্থ:
- নজরুল গীতি, অখণ্ড
- প্রথম সংস্করণ [আব্দুল আজীজ আল-আমান সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। ৬ আশ্বিন ১৩৮৫। ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮]
- দ্বিতীয় সংস্করণ [আব্দুল আজীজ আল-আমান সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। ১ শ্রাবণ ১৩৮৮। ১৭ জুলাই ১৯৮১]
- তৃতীয় সংস্করণ [ব্রহ্মমোহন ঠাকুর সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। ৮ মাঘ ১৪১০। ২৩ জানুয়ারি ২০০৪। রাগ-প্রধান গান। ৮৭৫ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা ২২২]
- নজরুল-সংগীত সংগ্রহ [রশিদুন্ নবী সম্পাদিত। কবি নজরুল ইনস্টিটিউট। তৃতীয় সংস্করণ দ্বিতীয় মুদ্রণ, আষাঢ় ১৪২৫। জুন ২০১৮। গান ১৪৯৩। পৃষ্ঠা ৪৪৮-৪৪৯]
- নবরাগ
- নজরুল ইনস্টিটিউট। সেপ্টেম্বর ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দ। ১ম গান। পৃষ্ঠা ১-৩]
- দ্বিতীয় সংস্করণ। [হরফ প্রকাশনী। কবি ন জরুলের ৭৩তম জন্মদিন, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ। ১ম গান। পৃষ্ঠা ৯-১০]
- বুলবুল দ্বিতীয় খণ্ড
- প্রথম সংস্করণ [১৩৫৯ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ (২৫ মে ১৯৫২)।
- নজরুল-রচনাবলী─ষষ্ঠ খণ্ড [নজরুল জন্মশতবর্ষ সংস্করণ। বাংলা একাডেমী, ১২ই ভাদ্র ১৪১৪। ২৭শে আগস্ট, ২০০৭। ৬৬ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা ২৮৭]
- সন্ধ্যামালতী
- প্রথম সংস্করণ [শ্রাবণ ১৩৭৭ (জুলাই-আগষ্ট ১৯৭১)]
- নজরুল রচনাবলী জন্মশতবার্ষিকী সপ্তম খণ্ড [১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৫, ২৫ মে ২০০৮। সন্ধ্যামালতী, গান ৫৬। পৃষ্ঠা: ১৫৩]
- পত্রিকা:
- নজরুল গীতি, অখণ্ড
- রেকর্ড:
- সেনোলা [এপ্রিল ১৯৪০ (চৈত্র ১৩৪৬-বৈশাখ ১৩৪৭)। কিইএস ৪৫৬। শিল্পী: গীতা মিত্র][শ্রবণ নমুনা]
- বেতার:
- নবরাগ মালিকা। (গীতিনাট্য)। কলকাতা বেতারকেন্দ্র [১৩ জানুয়ারি ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দ ১৩ জানুয়ারি ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দ (শনিবার ১৯ পৌষ ১৯৪৭) সান্ধ্য অনুষ্ঠান। ৭.২০-৮.০৪ মিনিট। রাগ: নির্ঝরিণী (নজরুল-সৃষ রাগ)।
- সূত্র:
- বেতার জগৎ পত্রিকার ১১শ বর্ষ ১ম সংখ্যার অনুষ্ঠান সূচী [পৃষ্ঠা: ৪৪]
- বেতার জগৎ পত্রিকার ১১শ বর্ষ ২য় সংখ্যায় [পৃষ্ঠা: ৬১-৬৪]
- সূত্র:
- নবরাগ মালিকা। (গীতিনাট্য)। কলকাতা বেতারকেন্দ্র [১৩ জানুয়ারি ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দ ১৩ জানুয়ারি ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দ (শনিবার ১৯ পৌষ ১৯৪৭) সান্ধ্য অনুষ্ঠান। ৭.২০-৮.০৪ মিনিট। রাগ: নির্ঝরিণী (নজরুল-সৃষ রাগ)।
- সুরকার: নজরুল ইসলাম
- স্বরলিপিকার:
- জগৎ ঘটক।
- ভারতবর্ষ। ফাল্গুন ১৩৪৭। ফেব্রুয়ারি- মার্চ ১৯৪১। [নমুনা]
- জগৎ ঘটক। [নবরাগ (নজরুল ইনস্টিটিউট। সেপ্টেম্বর ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দ)] গান ১। [নমুনা]
- আহসান মুর্শেদ [নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপি, পঁয়তাল্লিশতম খণ্ড, কবি নজরুল ইসলাম ইনস্টিটিউট। জুন ২০১৮] গান সংখ্যা ১৩। পৃষ্ঠা: ৫৬-৫৭ [নমুনা]
- বিষয়াঙ্গ: নাট্যগীতি (প্রকৃতি ও সঙ্গীত)
- সুরাঙ্গ: খেয়ালাঙ্গ
- রাগ: দোলন-চাঁপা (নজরুল-সৃষ্ট রাগ)
- তাল: ত্রিতাল।
- গ্রহস্বর:ষড়্জ।
- জগৎ ঘটক।