কুঁচবরণ কন্যা রে তার মেঘ-বরণ কেশ (kunchboron konya re tar megh-boron kesh)

কুঁচবরণ কন্যা রে তার মেঘ-বরণ কেশ।
ওরে    আমায় নিয়ে যাও রে নদী সেই সে কন্যার দেশ রে॥
         পরনে তার মেঘ-ডম্বুর  উদয়-তারার শাড়ি
ওরে    রূপ নিয়ে তার চাঁদ-সুরুজে করে কাড়াকাড়ি রে
আমি   তারি লাগি রে
         আমি তারি লাগি বিবাগী ভাই আমার চির-পথিক বেশ॥
         পিছ্‌লে পড়ে চাঁদের কিরণ নিটোল তারি গায়ে
ওরে    সন্ধ্যা-সকাল আসে তারি' আল্‌তা হতে পায়ে রে।
ও সে   রয় না ঘরে রে
ও সে   রয় না ঘরে ঘুরে' বেড়ায় ময়নামতীর চরে
তা'রে   দেখ্‌লে মরা বেঁচে ওঠে জ্যান্ত মানুষ মরে রে
ও সে   জল-তরঙ্গে বাজে রে তার সোনার চুড়ির রেশ॥

  • ভাবার্থ: এই গানে দূরদেশী কোন এক কুঁচবরণ কন্যার রূপের মহিমা বর্ণা করা হয়েছে। এই গানের কুঁচবরণ কন্যা মূলত কবির মানস-প্রেমিক। অপরূপ  অলৌকিক সৌন্দর্যের অধিকারণী এই কন্যার বিচরণ মানসলোকে । কবির কাছে এই কন্যা চিরচেনা হয়ে চির-অচেনা, মনোলোকের একান্ত সহচরী হয়েও সে দূরবাসিনী। রূপমুগ্ধ কবি এই কন্যার সন্ধানের ঘর-বিবাগী পথিক।

    তাঁর এই কল্পলোকের এই মানস-সুন্দরীকে তিনি রূপকথার মোহময়ী মূর্তিতে সাজিয়েছেন। গানটির স্থায়ী থেকে সঞ্চারী পর্যন্ত কবি তাঁর দেহ-সৌন্দর্য এবং তার বেশ-ভূষার বর্ণা করেছেন উপমা ও রূপকতায়। আর আভোগে এসে কবি উপস্থাপন করেছেন তার অলৌকিক রূপ।

    এই গানের কুঁচবরণ কন্যার রূপ উপস্থাপন করা হয়েছে, বাংলার রূপকথায় বর্ণিত অপরূপা নায়িকার রূপকতায়। বাংলা লোকসাহিত্যের নায়িকার গাত্র-রূপ বর্ণনার একটি সাধারণ বিশেষণ হলো- 'কূঁচবরণ'। মূলত কূঁচ হলো-শিম্বাদি বর্গের আবরুস গণের একটি উদ্ভিদ এবং এর ফলের নাম। প্রজাতিভেদে কুঁচফল কালো, লাল, শাদা, ধূসর ইত্যাদি এক বর্ণ বা মিশ্র বর্ণের হতে পারে। এই ফলের মিশ্র রঙ মনোমুগ্ধকর। রূপকথার 'কুঁচবরণ' 'দুধে-আলতা'র মতো আদর্শিক একক বর্ণরূপ কে তুলে ধরে না। মূলত বাংলার রূপকথায় অনিন্দ্যসুন্দর গাত্রবর্ণ বুঝাতে 'কুঁচবরণ' শব্দটি বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এই কন্যার মসৃণ গাত্রে যেন চাঁদের কিরণও পিছলে পড়ে। পদযুগল রঞ্জিত করে দিয়ে যায় সকাল-সন্ধ্যার রক্তিম আভা।  শুভ্র উদয়তারা (শুকতারা) খচিত, মেঘডম্বুর (মেঘবর্ণের ডুমুর) শাড়ি পরিহিতা- এই কন্যার 'মেঘ-বরণ কেশ', 'চাঁদ-সুরুজের কাড়াকাড়ি' এ সবই রূপকথার উপমা।

    এই মানস-কন্যাকে পাওয়ার জন্য রাজপুত্ররূপী কবি মনোলোকের দীর্ঘ অভিযাত্রা। এই অভিযাত্রী কবি কাব্যলোকের রাজপুত্র। কবির মানস-সুন্দরী কোনো রাজপ্রসাদে বন্দিনী নয়। কবির মানসসুন্দরী ঘুরে বেড়ায় ময়নামতীর চরে আলেয়ার মতো। এই সর্বাঙ্গসুন্দরীর রূপ মৃত্যুঞ্জয়ী, আবার একই সাথে মৃত্যুপ্রদায়ী। এই দ্বৈত-রূপ বর্ণানায় কবি উপস্থাপন করেছেন কাব্যিক-আলোছায়ার খেলা। কবি মনে করেন এই কন্যার অলৌকিক মোহময়ী রূপ দেখার জন্যই যেন মৃতদেহে প্রাণের সঞ্চার ঘটবে, আমার সৌন্দর্যের পায়ে সৌন্দর্যপিপাসু আত্মাহুতিও দেবে প্রেমিক পুরুষ। তার ময়নামতীর ছল ছল নদীর তরঙ্গে বাজে যেন তার সোনার চুড়ির রিনিঝিনি ধ্বনি। এই ধ্বনিতে রয়েছে এই অপরূপারা মৃত্যুঞ্জয়ী এবং মৃত্যুপ্রদায়ী অমোঘ আহ্বান।
  • রচনাকাল ও স্থান:  গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। সঙ্গীত বিজ্ঞান প্রবেশিকা, ২য় সংখ্যা [জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৯ (মে-জুন ১৯৩২)।  শৈলেশ দত্তগুপ্ত-কৃত স্বরলিপি-সহ মুদ্রিত হয়েছিল। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ৩২ বৎসর ১১ মাস।
         
    নন্দগোপাল সেনগুপ্তের অনুরোধে নজরুল এই গানটি রচনা করেছিলেন। এ বিষয়ে নন্দগোপাল সেনগুপ্ত লিখেছিলেন ─

"আমার ফরমায়েশে তিনি দুটি গান লিখে দিয়েছিলেন একটি পত্রিকায়, পরে দুটিই প্রসিদ্ধ হয়েছে। একটা হলো- 'কুঁচ বরণ কন্যা রে' আর একটা 'ঐ ঘর ভুলানো সুরে'। দুটোরই পাণ্ডুলিপি এখনও আমার কাছে আছে।"
[সূত্র: নজরুল সঙ্গীত নির্দেশিকা, ব্রহ্মমোহন ঠাকুর (নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা। প্রথম সংস্করণ। ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৬। ২৫ম মে ২০০৯)। ৮৪২ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা ২২৪-২২৫]

  • গ্রন্থ:
    • নজরুল গীতি, অখণ্ড
      • প্রথম সংস্করণ [আব্দুল আজীজ আল-আমান সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। ৬ আশ্বিন ১৩৮৫। ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮]
      • দ্বিতীয় সংস্করণ [আব্দুল আজীজ আল-আমান সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। ১ শ্রাবণ ১৩৮৮। ১৭ জুলাই ১৯৮১]
      • তৃতীয় সংস্করণ [ব্রহ্মমোহন ঠাকুর সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। ৮ মাঘ ১৪১০। ২৩ জানুয়ারি ২০০৪। লোকগীতি। ২০২৫ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা ৫৩৫]
      • পরিবর্ধিত সংস্করণ [আব্দুল আজীজ আল-আমান সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। বৈশাখ শ্রাবণ ১৪১৩। এপ্রিল-মে ২০০৬] ১৭৬৩ সংখ্যাক গান। পৃষ্ঠা: ৩৪৯।
    • নজরুল-সংগীত সংগ্রহ [রশিদুন্ নবী সম্পাদিত। কবি নজরুল ইন্সটিটিউট। তৃতীয় সংস্করণ দ্বিতীয় মুদ্রণ, আষাঢ় ১৪২৫। জুন ২০১৮। গান ৮। পৃষ্ঠা ৩]
    •  নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপি (প্রথম খণ্ড)। স্বরলিপিকার: সুধীন দাশ। প্রথম প্রকাশ, তৃতীয় মুদ্রণ [কবি নজরুল ইন্সটিটিউট। অগ্রহায়ণ ১৪০২। নভেম্বর ১৯৯৫। ৮ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা ৫৪-৫৮] [টুইন, এফটি ২২২৭]
  • সুর-সাকী
    • প্রথম সংস্করণ [আষাঢ় ১৩৩৯ বঙ্গাব্দ। জুলাই ১৯৩২] গান সংখ্যা ৫০। ভাটিয়ালি-কার্ফা।
    • নজরুল রচনাবলী, জন্মশতবর্ষ সংস্করণ, চতুর্থ খণ্ড। বাংলা একাডেমী, ঢাকা। [জ্যৈষ্ঠ ১৪১৮।  মে ২০১১। সুর-সাকী। ৫০। ভাটিয়ালি-কার্ফা। পৃষ্ঠা: ২০৯]
  • রেকর্ড:
    • হিন্দুস্থান [সেপ্টেম্বর ১৯৩২ (ভাদ্র-আশ্বিন ১৩৩৯)। শিল্পী উমাপদ ভট্টাচার্য। নম্বর এইচ ৭] 
    • টুইন [অক্টোবর ১৯৩২ (আশ্বিন-কার্তিক ১৩৩৯)। শিল্পী: আব্বাস উদ্দীন। নম্বর এফটি ২২২৭] [শ্রবণ নমুনা]
  • পত্রিকা: সঙ্গীত বিজ্ঞান প্রবেশিকা [জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৯ (মে-জুন ১৯৩২)। শৈলেশ দত্তগুপ্ত-কৃত স্বরলিপি-সহ মুদ্রিত হয়েছিল]
  • স্বরলিপিকার ও স্বরলিপি:

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।