নীলাম্বরী-শাড়ি পরি' নীল যমুনায় কে যায় (nilambori shari pori nil jomunay)

নীলাম্বরী-শাড়ি পরি' নীল যমুনায় কে যায়?
যেন জলে চলে থল-কমলিনী ভ্রমর নূপুর হয়ে বোলে পায় পায়॥
             কলসে কঙ্কণে রিনিঝিনি ঝনকে,
             চমকায় উন্মন চম্পা বনকে,
দলিত অঞ্জন নয়নে ঝলকে, পলকে খঞ্জন হরিণী লুকায়॥
অঙ্গের ছন্দে পলাশ-মাধবী অশোক ফোটে,
নূপুর শুনি' বনতুলসীর মঞ্জরি উলসিয়া ওঠে।
             মেঘ-বিজড়িত রাঙা গোধূলি
             নামিয়া এলো বুঝি পথ ভুলি,
তাহারি অঙ্গ তরঙ্গ-বিভঙ্গে কূলে কূলে নদী জল উথলায়॥

  • ভাবসন্ধান: কোনো এক সুবেশা সর্বাঙ্গ সুন্দরী যমুনা নদীতে কলসী কাঁখে জল আনতে যাচ্ছেন। তাঁর সৌন্দর্য সন্দর্শনে কবি মুগ্ধ। নানা উপমায় কবি সেই অনিন্দ্যসুন্দরীকে উপস্থাপন করেছেন এই গানে। এই গানের রূপসীকে তিনি উপস্থাপন করেছেন শ্রীরাধার ধ্যানে। ব্রজের শ্রীধার মতই এই নীলাম্বরী সুন্দরী কলসী কাঁখে যমুনায় জল আনতে চলেছেন।

    জল আনতে যাওয়া এই নীলাম্বরী সুন্দরী কে? সেটাই জানার জন্য কবির এই কৌতুহলী প্রশ্ন, নাকি বিস্ময়। সাধারণ কৌতুহল এবং বিস্ময়ের মিশ্রণে 'কে যায়!?'- হয়ে উঠেছে দ্ব্যর্থক।

    গানের স্থায়ীর প্রথম পংক্তির 'কে যায়!?' এই দ্ব্যর্থ অনুভব, সুরের ক্রম বক্র-আরোহণের অভিঘাতে সাধারণ দশা থেকে তীব্রতর দশায় উত্তোরণ ঘটায়। এই গানে 'কে যায়' তিনটি ধাপে উপস্থাপিত হয়েছে। প্রথম ধাপে নীলাম্বরী সুন্দরী ছিল কবির কাছাকাছি। তখন 'কে যায়' ছিল স্বগোক্তির মতো তাই সুরের প্রকাশ ঘটেছে উদারা কোমল নিষাদ ছুয়ে কোমল গান্ধারে। এখানে রয়েছে ণ্ থেকে জ্ঞ-এ মীড়পাত। কবি এই সুন্দরীর পরিচয় জানতে পারেন না। তাই স্বগোক্তি থেকে কবি বেরিয়ে এসে দ্বিতীবার একটু উচ্চস্বরে বলেন 'কে যায়!?'। এখানে স্বরবিন্যাসে মপা মজ্ঞা। এখানে এখানে ম থেকে জ্ঞ-এ মীড়পাত। তৃতীয় বারের 'কে যায়?' আরও উচ্চকিত। এই সুন্দরীকে জানা হলো না বলেই আকুতি ফুটে উঠে নধা -পধপা স্বরবিন্যাসে।

    গানের স্থায়ীর দ্বিতীয় পংক্তিতে কবি চলে যাওয়া নীলাম্বরী সুন্দরীর সৌন্দর্যের রূপ-কল্প উপস্থাপন করেছেন সুর ও বাণীর যুগলবন্দীতে। কবি বৈষ্ণব কাব্য থেকে রাধার রূপক বিশেষণ থল-কমলিনী তুলে এনেছেন। এখানে এই সুন্দরী স্থল-পদ্ম-স্বরূপিণী শ্রীরাধার মতই শ্রীময়ী। চলার পথে তাঁর পয়ের নূপর যেন প্রণয়-ভ্রমরের মতো গুঞ্জন করে চলেছে। ফুলের উপর মধু-পিয়াসী ভ্রমর যেমন আন্দোলিত হয়- সুন্দরীর পায়ে পায়ে কবি সেই প্রণয়-পিয়াসী ভ্রমরের অভিসার দেখতে পান। এখানে 'পায় পায়' শব্দ দুটি,  জ্ঞ র স ধ্ সুরের ধ্বনিচিত্র তৈরি করে এবং এই সুরের সঙ্গ নিয়ে ভাবের আন্দোলনকে উদ্ভাসিত করে তোলে।

    অন্তরার প্রথম পংক্তিতে পাওয়া যায়- চলমান সুন্দরীর হাতের কাঁকন আর কলসের ঠোকাঠুকিতে সৃষ্ট মধুর ধ্বনি। কলস-কঙ্কনের মৈথুন-ধ্বনি বৈষ্ণবকাব্যে এটি সাধারণ একটি চিত্ররূপ। নজরুলের অন্য গানেও এ রূপ পাওয়া যায়। যেমন- 'একেলা গৌরী জলকে চলে গঙ্গা তীর'- গানে রয়েছে- 'কাঁকনে কলসে বাজে, কত কথা পথ মাঝে'। এই গানের কলস-কঙ্কনের মৈথুন-ধ্বনি উচ্চকিত। তাই এর রিনিঝিনি ধ্বনি ঝঙ্কৃত হয় তারার ঋষভ, কোমল গান্ধার, মধ্যমের সুরালঙ্কারে। এই ধ্বনি উচ্চকিত, কিন্তু মধ্যম ও কোমল গান্ধারের স্পর্শে এই ধ্বনি স্নিগ্ধ ও মনোমুগ্ধ হয়ে ওঠে। এই অংশের চমকায় ধ্বনিতে রয়েছে  ঋষভ ষড়্‌জ এবং কোমল নিষাদের স্বরসমন্বয়ে। এই সুরবিন্যাসে পাওয়া যায় সৌন্দর্যের স্নিগ্ধ চমক।

    এই গানের এই সাধারণ চিত্ররূপ অসাধারণ হয়ে ওঠে, যখন পরের পংক্তিতে কবি বলেন-  'চমকায় উন্মন চম্পা বনকে'। এই চমকানো শুধু ধ্বনির নয়। সাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে নীলাম্বরী সুন্দরীর আবির্ভাব। এখানে তিনি হয়ে উঠেছেন সৌন্দর্যের দেবী। অন্তরায় কবি এই সুন্দরীকে সুনয়না হিসেবে উপস্থাপন করছেন- উপমা এবং রূপকতার প্রচ্ছন্ন শব্দচিত্রে। এখানে সুন্দরীর কাজল-রঞ্জিত নয়নের সৌন্দর্যেবিভায় কাজলনয়না হরিণী, খঞ্জনা লজায় পালিয়ে যায়।

    সঞ্চারীতে এই সৌন্দর্যের দেবীর দৈব-প্রভাব আরও প্রবল হয়ে ধরা দিয়েছে। যেন দৈব-প্রভাবে তার সৌন্দর্য-বৈভব আর নূপরের ধ্বনির ছন্দে পলাশ, মাধবী, অশোক, বনতুলসীর শাখা মঞ্জরিত হয়ে ওঠে। রাঙা মেঘরঞ্জিত গোধুলী বর্ণবিভূষিত হয়ে অরণ্যে নেমে আসে। তার রূপতরঙ্গের ছোওয়ায় উদ্বেলিত হয়ে ওঠে নদীর তরঙ্গরাজি।
  • রচনাকাল ও স্থান: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ১লা ডিসেম্বর (শুক্রবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৩৪৬) তারিখে 'বেতার জগৎ' পত্রিকায় হরপ্রিয়া গীতি-আলেখ্য সম্পর্কে আগাম জানানো হয়েছিল। বেতার জগতের '১ ডিসেম্বর ১৯৩৯' সংখ্যায় এই অনুষ্ঠান সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছিল-

'হরপ্রিয়া (কাফি ঠাটের রাগ-রাগিণী)/রচনা ও সুর-সংযোজন: কাজী (য) নজরুল ইসলাম। ব্যবস্থাপনা: মনোরঞ্জন সেন, নিতাই ঘটক প্রভৃতি'। সূত্র: বেতারে নজরুল: ব্রহ্মমোহন ঠাকুর।

The Indian Listener (22 november 1939- Vol-IV-23) -পত্রিকায় উল্লেখ ছিল-

‌'A picture in music dealing with the ragas and raginees of the Kafi That Composed and tuned by Nazrul Islam Presented by Monoranjan Sen, Nitai Ghatak and others'

ধারণা করা হয়, এই গীতি আলেখ্যের সকল গান ডিসেম্বর মাসের আগেই রচিত হয়েছিল।  ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ৫ ডিসেম্বর (মঙ্গলবার, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৩৪৬), সন্ধ্যা ৭.০৫টায় কলকাতা বেতারকেন্দ্র (কলকাতা ক-এর চতুর্থ অধিবেশন) থেকে প্রচারিত হয়েছিল। এই সময় নজরুল ইসলামের বয়স ছিল ৪০ বৎসর ৬ মাস।

  • পত্রিকা:
    • বেতার জগৎ [১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৪০ (শুক্রবার, ৩ ফাল্গুন ১৩৪৬)। ' কাবেরী তীরে।]
  • বেতার:
    • হরপ্রিয়া (নাটিকা।  বিষয়: কাফি ঠাটের রাগরাগিণী)
      • কলকাতা বেতারকেন্দ্র। [৫ ডিসেম্বর ১৯৩৯ (মঙ্গলবার ১৯ অগ্রহায়ণ ১৩৪৬)।  সান্ধ্য অনুষ্ঠান। ৭.০৫-৭.৪৯। শিল্পী: শৈল দেবী।]
        • সূত্র: বেতার জগৎ পত্রিকরা ১০ম বর্ষ ২৩শ সংখ্যার অনুষ্ঠান সূচী [পৃষ্ঠা: ৯১৭]
    • কাবেরী তীরে (গীতি-নাট্য)।
      • প্রথম প্রচার। কলকাতা বেতার কেন্দ্র। [শনিবার ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৪০ (২০ মাঘ ১৩৪৬)। ৭.০৫-৭.৪৪ মিনিট।  চরিত্র: বণিক কুমার। শিল্পী: বিমল মুখোপাধ্যায় (বিমল ভূষণ)।  শিল্পী- শৈল দেবী।
           [সূত্র: বেতার জগৎ। ১১শ বর্ষ ৩য় সংখ্যা।  বৃহস্পতিবার, ১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪০, ১৮ মাঘ ১৩৪৬
      • দ্বিতীয় প্রচার: কলকাতা বেতার কেন্দ্র। ৮ নভেম্বর ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দ (শনিবার ২২ কার্তিক ১৩৪৮)।
        • সূত্র: বেতার জগৎ। ১২শ বর্ষ ২১শ সংখ্যা। অনুষ্ঠান সূচী। পৃষ্ঠা: ১২৮০
    • হারামণি। রাগ নীলাম্বরী। কলকাতা বেতার কেন্দ্র। মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল  ১৯৪১ (৯ বৈশাখ ১৩৪৮)। তৃতীয় অধিবেশন। ৮.১৫-৮.৩৯ মিনিট।
      • সূত্র: বেতার জগৎ। ১২শ বর্ষ, ৮ম সংখ্যার  অনুষ্ঠানসূচী [পৃষ্ঠা: ৪৪৬]
         
  • রেকর্ড: এইচএমভি [জুন ১৯৪৩ (জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় ১৩৫০)। এন ২৭৩৭৮। শিল্পী: ধীরেন্দ্রচন্দ্র মিত্র।][শ্রবণ নমুনা]
     
  • স্বরলিপি ও স্বরলিপিকার:
  • পর্যায়

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।