এ কি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী-জননী (eki oporup rupe maa tomay)
রাগ:বেহাগ মিশ্র, তাল:দাদ্রা।
এ কি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী-জননী।
ফুলে ও ফসলে কাঁদা মাটি জলে ঝলমল করে লাবনি॥
রৌদ্রতপ্ত বৈশাখে তুমি চাতকের সাথে চাহ জল,
আম কাঁঠালের মধুর গন্ধে জ্যৈষ্ঠে মাতাও তরুতল।
ঝঞ্ঝার সাথে প্রান্তরে মাঠে কভু খেল ল'য়ে অশনি॥
কেতকী-কদম যূথিকা কুসুমে বর্ষায় গাঁথ মালিকা,
পথে অবিরল ছিটাইয়া জল খেল চঞ্চলা বালিকা।
তরাগে পুকুরে থই থই করে শ্যামল শোভার নবনী
শাপলা শালুক সাজাইয়া সাজি শরতে শিশির নাহিয়া,
শিউলি-ছোপানো শাড়ি পরে ফের আগামনী-গীত গাহিয়া।
অঘ্রাণে মা গো আমন ধানের সুঘ্রানে ভরে অবনি॥
শীতের শূন্য মাঠে তুমি ফের উদাসী বাউল সাথে মা,
ভাটিয়ালি গাও মাঝিদের সাথে গো, কীর্তন শোনো রাতে মা।
ফাল্গুনে রাঙা ফুলের আবিরে রাঙাও নিখিল ধরণী॥
- ভাবসন্ধান: এই গানের অপরূপ মাতৃরূপিণী বাংলা হলো- ষড়ঋতুর অপরূপ বৈভবে সমৃদ্ধ বাংলার পল্লী-জননী। কবির এই বাংলা 'জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী (জননী ও জন্মভূমি স্বর্গের চেয়েও শ্রেষ্ঠ), জীবনানন্দের 'রূপসী বাংলা'র চেয়ে মহান।
পল্লীর চিরচেনা রূপের ভিতরে কবি যেন হঠাৎ করে খুঁজে পান মাতৃরূপিণী অপরূপ পল্লী বাংলাকে। এই হঠাৎ দেখার উচ্ছাসে আবেগাপ্লুত কবি মুগ্ধবিস্ময়ে বলে উঠেন - 'এ কি অপরূপ রূপে মা তোমার হেরিনু পল্লী জননী'। তিনি বাংলার সকল রূপের ভিতরেই 'এই অপরূপ রূপ' দেখতে পেয়েছেন। তাই ফুল ও ফসলের বাংলা এবং কাদা-মাটি-জলের বাংলা, উভয়ই তাঁর কাছে ঝলমলে লাবণ্যময়।
রৌদ্তপ্ত বৈশাখে চাতকের মতো জলহীন তৃষাতুর পল্লী, আম-কাঁঠালের গন্ধে মাতানো ছায়াঢাকা তরুতলের স্নিগ্ধ জৈষ্ঠের পল্লী,আষাঢ়ের ঝড়-ঝঞ্চাময় বজ্রবৃষ্টি স্নাত পল্লীর প্রান্তর সবই কবির কাছে অপরূপ। শ্রাবণের ঘন কেতকী, কদম,যূথিকা ফুলের সমারোহে বর্ষায় পল্লী হয়ে ওঠে পল্লীজননী, কখনো হয়ে ওঠে মালঞ্চের মালাকারিণী,কখনো অবিরল জল ছিটানো চঞ্চলা বালিকা। জল থৈ ধৈ দীঘি (তরাগ)ও পুকুরে শ্যামল শোভার পল্লীবালিকা হয়ে ওঠে স্নিগ্ধ নবযৌবনা।
শরতে জলাশয়গুলো হয়ে ওঠে যেন শাপলা-শালুকের সাজানো পুষ্পডালা। শরতের মৃদু স্নিগ্ধ শিশির-স্নাত পল্লী জননীর অঙ্গাবরণ হয়ে ওঠে শিউলির শুভ্রতায় শোভিত। যেন শুভলক্ষ্মীর আগমনের গান ছড়িয়ে পড়ে চতুর্দিক। অগ্রহায়ণের নতুন ধানের সুঘ্রাণে আমোদিত হয়ে ওঠে। শীতের ফসলশূন্য মাঠে সকল সৌন্দর্য হারিয়ে পল্লী হয়ে ওঠে উদাসী বাউলের মতো। শীর্ণ নদীর উজানে মাঝিদের ভাটিয়ালী সুরের সাথে একাকার হয়ে যায় পল্লীজননী, আবার কীর্তনের আসরে এই জননী আসে বিমুগ্ধ শ্রোতা হয়ে। অবশেষে বছরের অবসান হয় বসন্তে। ফাল্গুনের রাঙাফুলের আবিরে পল্লী জননী হয়ে ওঠে বর্ণবিভূষিতা।
রাগের সুক্ষ্ণাক্ষাতিসূক্ষ্ণ বিচারে এই গানের সুর বিচার্য নয়। ভাবের অনুষঙ্গে এ গানের সুরের বিহার। তাই এ গানের প্রতিটি পঙ্ক্তিতে চলে বিচিত্র সুরের বিহার। বিশেষ করে এ গানের শেষ অন্তরায়- বাণী যখন বলে 'ভাটিয়ালী গাও মাঝিদের সাথে গো', তখন সুরের বিহার হয় ভাটিয়ালী সুরাঙ্গে, পরক্ষণেই 'কীর্তন শোনো রাতে মা'-র সুর হয়ে যায় কীর্তনাঙ্গের। আবার ভাটিয়ালী ও কীর্তনের মিশ্রণে এ গানের সুরের সামগ্রিক রূপে হয়ে ওঠে উদাসী বাউলের সুর। - রচনাকাল ও স্থান: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই (আষাঢ়-শ্রাবণ ১৩৩৯) মাসে, টুইন রেকর্ড কোম্পানি থেকে গানটি প্রথম রেকর্ড প্রকাশিত হয়। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ৩৪ বৎসর ১ মাস।
- গ্রন্থ:
- সুরলিপি। [১৬ আগষ্ট ১৯৩৪ (বুধবার, ৩১ শ্রাবণ ১৩৪২)]। জগৎঘটক-কৃত স্বরলিপি। প্রকাশক: নজরুল ইসলাম। মিশ্র-সিন্ধু-কার্ফা। পৃষ্ঠা: ৭৩-৭৫। [নমুনা]
- রেকর্ড: টুইন [জুলাই ১৯৩৩ (আষাঢ়-শ্রাবণ ১৩৩৯)। এফটি ২৮২১। শিল্পী: মাস্টার কমল [শ্রবণ নমুনা]
- পত্রিকা: ছায়াবীথি। বৈশাখ ১৩৪১ (এপ্রিল-মে ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দ)
- সুরকার: কাজী নজরুল ইসলাম
- স্বরলিপি ও স্বরলিপিকার: জগৎঘটক। সুরলিপি। [নমুনা]
- পর্যায়:
- বিষয়াঙ্গ: প্রকৃতি ও স্বদেশ
- সুরাঙ্গ: মিশ্র
- তাল: দাদরা
- গ্রহস্বর: সা