পরদেশী মেঘ যাও রে ফিরে। (porodeshi megh jao re fire)

        পরদেশী মেঘ যাও রে ফিরে।
          বলিও আমার পরদেশী রে॥
          সে দেশে যবে বাদল ঝরে
          কাঁদে নাকি প্রাণ একেলা ঘরে,
বিরহ-ব্যথা নাহি কি সেথা বাজে না বাঁশি নদীর তীরে॥
বাদল-রাতে ডাকিলে 'পিয়া পিয়া পাপিয়া',
বেদনায় ভ'রে ওঠে নাকি রে কাহারো হিয়া।
          ফোটে যবে ফুল, ওঠে যবে চাঁদ
          জাগে না সেথা কি প্রাণে কোন সাধ,
দেয় না কেহ গুরু গঞ্জনা সে দেশে বুঝি কুলবতী রে॥

  • ভাবার্থ: গানটি কবি কালিদাসের 'মেঘদূত কাব্যে'র অনুসরণে রচিত। কালিদাসের মেঘদূতে দেখি- কোনো এক যক্ষ তাঁর কর্তব্য অবহেলার কারণে, এক বৎসরে জন্য রামগিরির আশ্রমে নির্বাসিত হন। বিরহকাতর যক্ষ আষাঢ়ের প্রথম মেঘ দর্শনে প্রিয়ার সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য আকুল হয়ে উঠেন। পুরো মাস জুড়ে জমে ওঠা মনের কথা, ব্যক্ত করার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন। অবশেষে শ্রাবণ মাসে, তিনি তাঁর প্রেয়সীর কাছে মনের কথা জানানোর জন্য মেঘকে দূত হওয়ার অনুরোধ করেন।

    মেঘদূতের বিরহী যক্ষ তাঁর বার্তা পাঠিয়েছিলেন প্রেয়সীকে । সে বার্তা পাওয়ার পর প্রেয়সীর মনে যে ভাবান্তর ঘটেছিল, কবি যেন এই গানের মধ্য দিয়ে তার প্রত্যুত্তর দিয়েছন। তাই প্রেয়সী এ গানের শুরুতেই মেঘদূতকে জানাচ্ছেন- 'পরদেশী মেঘ যাও রে ফিরে‌/ বলিও আমার পরদেশীরে'। অর্থাৎ হে ভিনদেশী মেঘ, তুমি ফিরে গিয়ে প্রবাসী প্রেমিকাকে আমার কথা ব্যক্ত করো।

    অন্তরার তিনটি পংক্তিতে বিরহিণী অভিমানের আভাষ পাওয়া যায়। তিনি বলেন- তাঁর পরদেশী প্রেমিকের দেশে যখন বর্ষা নেমে আসে, তখন কি একলা ঘরে সঙ্গহীন সঙ্গীহীন বিরহব্যথায় তাঁর মন কাতর হয় না। সে দেশের নদীতীরে কি বিরহ-ব্যথায় করুণ বাঁশি বাজে না। অন্তরার এই কয়েকটি পংক্তিতে বিরহিণী পরোক্ষভাবে পরদেশী মেঘকে তাঁর মনের কথা জানান। তাঁর প্রকাশে থাকে স্বগোক্তির প্রচ্ছন্ন ভঙ্গি।

    এই ভঙ্গিটিই সঞ্চারিত হয়েছে সঞ্চারি ও আভোগে। সঞ্চারি বার্তা বিরহিণী মনের কথা প্রকাশ করেন ভাববাচ্যে। বলেন- বাদল রাতে পাপিয়া যখন পিয়া পিয়া বলে ডাকে। তখন কি কারো মনে বিরহ-বেদনায় ভরে ওঠে না!? যখন ফুল ফোটে, চাঁদ ওঠে, তখন কি তার মনে কোনো আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে না!? গানটির শেষ পংক্তিতে দেখি কূলবধূর বিরহ-ব্যথার সাথে গুরু-গঞ্জনার যন্ত্রণার কথা। কূলবধূর বিরহ-ব্যথা দেখে সংসারের গুরুজনেরা হয়তো আদিখ্যেতা ভেবে গঞ্জনা দেয়, যার ভিতর কূলবধূর অসহায়ত্ব আরো তীব্রততর হয়ে ওঠে।

    গানটির ভাব প্রকাশে ছন্দের ব্যবহারও লক্ষণীয়। বিরহিণীর যাপিত-জীবন মসৃণ নয়। সেখানে পদে পদে রয়েছে সংসারের গুরু-গঞ্জনা, ক্ষণে ক্ষণে জেগে ওঠা বিরহকাতরতার যন্ত্রণা। এই গানের আদ্ধা তালের চলন যেন যাপিত-জীবনের বন্ধুর পথকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।

     
  • রচনাকাল ও স্থান:  গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। কবির জীবদ্দশায় কোনো মাধ্যমেই প্রকাশিত হয় নি।
     
  • গ্রন্থ:
    • নজরুল-গীতি, অখণ্ড। রাগ-প্রধান গান, ৮৮৮ সংখ্যক গান (হরফ প্রকাশনী, মাঘ ১৪১০। জানুয়ারি ২০০৪)। পৃষ্ঠা: ২২৪। ব্রহ্মমোহন ঠাকুর -রচিত নজরুল সঙ্গীত নির্দেশিকা (নজরুল ইন্সটিটিউট, জ্যৈষ্ঠ ১৪১৬। মে ২০০৯) গ্রন্থে   গানটি সম্পর্কে একটি বিশেষ তথ্য পাওয়া যায়, তা হল− ‌'পাণ্ডুলিপিতে কবির সুর নির্দেশ  'রাগ-সিংহেন্দ্র মধ্যম'  কিন্তু  কাজী অনিরুদ্ধ পরিবর্তিত সুরে স্বরলিপি করেছেন।
      [পৃষ্ঠা: ৪৪৫]।

       
  • স্বরলিপিকার ও স্বরলিপি:
    • কাজী অনিরুদ্ধ। [সুনির্বাচিত নজরুল গীতির স্বরলিপি, প্রথম খণ্ড, ৬ সংখ্যক গান (সাহিত্যম, মহালয়া ১৩৮২ বঙ্গাব্দ। অক্টোবর ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দ)। পৃষ্ঠা: ২৩-২৫]।
    • কাজী অনিরুদ্ধ। নিতাই ঘটক। [সুনির্বাচিত নজরুল গীতির স্বরলিপি, প্রথম খণ্ড, ৬ সংখ্যক গান (সাহিত্যম, মহালয়া ১৩৮২ বঙ্গাব্দ। অক্টোবর ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দ)। পৃষ্ঠা: ২৩-২৫]।
       
  • পর্যায়

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।