প্রভাত বীণা তব বাজে হে (probhat bina tobo baje hey)

প্রভাত বীণা তব বাজে হে
উদার অম্বর মাঝে হে

তুষার কান্তি তব প্রশান্তি
শুভ্র আলোকে বাজে হে

তব আনন্দিত গভীর বাণী
শোনে ত্রিভুবন যুক্ত পাণি
মন্ত্রমুগ্ধ ভাব গঙ্গা নিস্তরঙ্গা লাজে হে

  • ভাবসন্ধান: বিশ্বজগত প্লাবিত হয়ে আছে পরম সুরস্রষ্টার পরম আহত-অনাহত সুরধ্বনিতে। সেই ধ্বনিই যেন প্রভাতের প্রশান্ত আকাশে শুভ্র-সুন্দরের ছন্দে সঙ্গীতময় হয়ে উঠেছে। কবি সে পরম সুর ও সুরস্রষ্টার বন্দনা করেছেন এই গানে। কবি -কল্পনায় স্রষ্টার এই স্নিগ্ধ, প্রশান্ত এবং জ্যোতির্ময় রূপ যেন প্রকৃতির প্রভাতী বীণার ধ্বনিতে ঝংকৃত। তাই তিনি প্রভাতের স্নিগ্ধ-শুভ্র আলোক তরঙ্গের ভিতরে বীণাধ্বনিকে অনুভব করেন পরম মুগ্ধতায়। এই সুরপ্রবাহের কবি অনুভব করেছেন জগতের এমন এক প্রশান্তি, যা এই বিপুল সুরতরঙ্গের প্রবহমান আনন্দধারায় বাঙ্ময় হয়ে জগত সংসারকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। আর পরমভক্তিতে, মোহিত হয়ে যেন তা শ্রবণ করে চলেছে ত্রিভুবন। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া সে বীণার ঝংকারে, ভক্তের মনের গভীরে চলমান চঞ্চল ভাবতরঙ্গ স্তব্ধ হয়ে যায়। তাই মন্ত্রমুগ্ধ চরাচর বিনম্র লাজে পরম ভক্তিতে শুধু সে বীণাধ্বনি শ্রবণ করে। প্রভাতের সে ব্রাহ্মমুহূর্তে কবি অনুভব করেন জগতগুরুর বিশ্বসঙ্গীতের অপরূপ মোহনীয় সুরধারা।

সঙ্গীতবিজ্ঞান প্রবেশিকা পত্রিকার 'অগ্রহায়ণ ১৩৪২ সংখ্যা'য় [পৃষ্ঠা: ৪৫৬-৪৫৭] প্রকাশিত কমল দাশগুপ্তকৃত স্বরলিপি অনুসারে জানা যায়, গানটি মিশ্র ভৈরোঁ (ভৈরব) ও তেওরা তালে নিবদ্ধ। নজরুল ইসলামের পাণ্ডুলিপির সংকলন 'হারানো গানের খাতা'তে দেখা যায় গানটি রচনা করেছিলেন এইএচএমভি রেকর্ড কোম্পানির জন্য। পাণ্ডুলিপিতে গানটির বিষয়াঙ্গের পরিচয় দেওয়া হয়েছে 'ভজন', আর রাগতালের উল্লেখ আছে 'ভৈরোঁ-গীতাঙ্গী'। উল্লেখ্য 'গীতাঙ্গী' তেওরার সমতূল্য ৭ মাত্রা বিশিষ্ট ৩।২।২ ছন্দে নিব্দ্ধ তিনটি তালি-যুক্ত তাল। বর্তমানে এই নামে কোনো তালের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় না।

নজরুল ইসলাম গানটিকে 'ভজন' উল্লেখ করেছেন, সম্ভবত বাণীর বিচারে। কিন্তু সুরাঙ্গের বিচারে ধ্রুপদ। ধ্রুপদী গাম্ভীর্য গানটির শুরু থেকেই লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে স্থায়ীতে 'বাজে' শব্দের 'জে' ধ্বনিতে নিষাদের স্পর্শে ষড়্জে আঘাত দিয়ে ধ্রুপদের গম্ভীর ভাবকে উৎসারিত করে। গানের স্থায়ীতে 'গমা পা মপা দা' সুরে বাঁধা 'হে' ধ্বনিগত মহাপ্রাণতামণ্ডিত ধ্রুপদীয় গমক তৈরি করে। একই সাথে সুরটির গাম্ভীর্য প্রবল হয়ে ওঠে যখন পরবর্তী 'উদার অম্বর'  ধ্বনিত হয় এবং তা মন্দ্র সপ্তকের শুদ্ধ নিষাদ হয়ে কোমল ধৈবতে পৌঁছায়। এর সাথে তেওরার অসম ছন্দ বিভাজনে, সুরের চলন আসে মন্দ্রমধুর ভাব এবং তা ভক্তি রসে সিক্ত হয়ে সুসমন্বিত সৌন্দর্যকে উদ্ভাসিত করে।

অন্তরাতে তব শব্দের 'ব', শুদ্ধ ধ্রুপদীয় গমক তৈরি করে। এরপর যখন 'রাজে হে' গমক-তানযুক্ত হয়ে মন্দ্রের শুদ্ধ নিষাদ ছুঁয়ে ষড়্‌জকে আঘাত করে, বাণী ও সুরের ভিতরে ঘটে গভীর মেলবন্ধন। এখানে গমক-তানটি বাণীকে 'সর্বত্র বিরাজ'-এর মহিমা দান করে।

সুরের ধারায় গমক ও তানের চাঞ্চল্যে স্থিতি দশা আসে পরের দুটি পংক্তিতে। যাতে স্রষ্টার আনন্দিত গভীর বাণীকে ত্রিভুবন বিনম্র শ্রদ্ধায় অনুভব করতে পারে। গানটির শেষ পংক্তিতে 'লাজে হে'- তানযুক্ত হওয়ায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টির করে। ফলে কিছুটা ভাব ও সুর সাংঘর্ষিক হয়ে উঠে। তবে তা, রাগাশ্রায়ী স্বরবিন্যাসে শ্রবণেন্দ্রিয়কে তৃপ্ত করে।

  • রচনাকাল ও স্থান: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে ১৮ সেপ্টেম্বর (মঙ্গলবার, ১ আশ্বিন ১৩৪১ বঙ্গাব্দ), এইচএমভি রেকর্ড কোম্পানির সাথে কয়েকটি গান প্রকাশের জন্য নজরুলের একটি চুক্তি হয়। এই চুক্তিপত্রে এই গানটির উল্লেখ ছিল। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ৩৬ বৎসর ৪ মাস।

    উল্লেখ্য, সঙ্গীত-বিজ্ঞান প্রবেশিকা পত্রিকার, অগ্রহায়ণ ১৩৪২ (ডিসেম্বর ১৯৩৫-জানুয়ারি ১৯৩৬) সংখ্যায় কমল দাশগুপ্ত-কৃত স্বরলিপি-সহ গানটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। উক্ত পত্রিকার ৪৫৬ পৃষ্ঠায় পাদটীকায় লেখা ছিল- 'উক্ত গানখানি "হিজ মাষ্টার্স ভয়েস্" রেকর্ডে গীত'। কিন্তু উক্ত রেকর্ডের প্রকাশকাল ছিল ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি (মাঘ-ফাল্গুন ১৩৪২)। উভয় তথ্যের বিচারে ধারণা যায়, রেকর্ডটি প্রকাশে বিলম্ব হয়েছিল।
     
  • রেকর্ড: এইচএমভি  [ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬ (মাঘ-ফাল্গুন ১৩৪২)। রেকর্ড নম্বর এন ৭৪৮৫। শিল্পী কমল দাশগুপ্ত] [শ্রবণ নমুনা] 
  • পত্রিকা: সঙ্গীত বিজ্ঞান প্রবেশিকা।  [১২শ বর্ষ, অষ্টম সংখ্যা, অগ্রহায়ণ ১৩৪২ (নভেম্বর-ডিসেম্বর ১৯৩৫)। মিশ্র ভৈরোঁ-তেওরা। কথা- কাজী নজরুল ইসলাম। সুর ও স্বরলিপি- শ্রীকমল দাশগুপ্ত। পৃষ্ঠা: ৪৫৬-৪৫৭ ]
     
  • স্বরলিপিকার ও স্বরলিপি:
  • সুরকার: কমল দাশগুপ্ত
  • পর্যায়:

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।