করুণ কেন অরুণ আঁখি দাও গো সাকি দাও শারাব (korun keno korun ankhi)

করুণ কেন অরুণ আঁখি দাও গো সাকি দাও শারাব
হায় সাকি এ আঙ্গুরী খুন নয় ও হিয়ার খুন-খারাব॥
আর সহে না দিল্ নিয়ে এই দিল্-দরদির দিল্‌লাগী,
তাইতে চালাই নীল পিয়ালায় লাল শিরাজি বে-হিসাব॥
হারাম কি এই রঙীন পানি আর হালাল এই জল চোখের?
নরক আমার হউক মঞ্জুর বিদায় বন্ধু!  লও আদাব॥
দেখ্ রে কবি, প্রিয়ার ছবি এই শারাবের আর্শিতে,
লাল গেলাসের কাঁচ্-মহলার পার হ'তে তার শোন্ জবাব্॥

  • পাঠভেদ: এই গানের পাঠ্যাংশে পাওয়া যায় স্থায়ীসহ। ৬টি স্তবক। কিন্তু রেকর্ডে পাওয়া যায়। স্থায়ীসহ ৩টি অন্তরা।
     
  • ভাবার্থ: পারশ্যের গজলের বিষায়ানুসঙ্গে গানটি রচিত। ভাবর্থের বিচারে এটি দ্ব্যর্থক। এর একটি হতে পারে পার্থিব ভোগবিলাসী রূপ, অপরটি হতে পারে- সুফিবাদী আধ্যত্মিক দর্শন।

    হাফিজের গজলে প্রতি অন্তরাতে স্বতন্ত্র দর্শন পাওয়া যায়। প্রতিটি অন্তরা উপস্থাপিত হয়, নতুন আঙ্গিকে। তাই অন্তরাভেদে ধারাবাহিকতা পাওয়া যায় না। কিন্তু সমগ্র গজলে পাওয়া যায় তার একটি অখণ্ড দর্শনগত রূপ। হাফিজের গজলে রয়েছে 'দেখা-না-দেখা মেশা' রহস্যময়তা। রয়েছে আলো-আঁধারের খেলা। এই খেলার উপকরণ সাকি, শারাব, নরক, আর্শী ইত্যাদি। নজরুল তাঁর এই গানে এসব উপকরণ অবলম্বনে- নরনারীর প্রেমলীলার রসে সাথে মিশিয়ে দিয়েছেন সুফিবাদের আধ্যত্মিক দর্শন।

    ভোগবাদী অর্থে এ গানের সাকি হলো মদ্য পরিবেশনকারিণী। কবির মাতাল রূপ দেখে সাকি বিষণ্ণ। কিন্তু এ সবের পরওয়া না করে, শরাব (মদ) পরিবেশনের জন্য সাকির কাছে আরও শরাব দেওয়ার করুণ মিনতি করছেন। কবি সাকিকে বলছেন- এ  শারাব শুধুই আঙুরের রক্তবর্ণের শরাব নয়, এ শরাব রঙ প্রেমে ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত হৃদয়ের বেদনা। প্রথম অন্তরাতে কবি বলছেন প্রেমের অভিনয় করে মন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা তিনি সহ্য করতে পারছেন না। তাই নীল পেয়ালায় রক্তিম শিরাজি (আঙুরে রস থেকে উৎপন্ন মদ) বেপরোয়া পান করে চলেছেন। গানের দ্বিতীয় অন্তরে কবি নিজের বেহিসেবি মদ্যপানের আত্মপক্ষ সমর্থনে যেন বলছেন- ইসলাম ধর্ম মতে- মদ্যপান হারাম। কিন্তু প্রেমে প্রতারিত কবির চোখের জল কি হালাল!? তাই বে-পরওয়া কবি অপরিনামদর্শী আবেগে গেয়ে ওঠেন- মদ্যপানের পাপে তাকে যদি নরকবাসী হতে হয়, তা হোক। তাই সুনীতির বাণী-প্রদায়িনী সাকিকে তাড়িত করে বলেন লও বিদায়। চরতুর্থ অন্তরাতে কবি শরাবের নেশার ঘোরে আয়নাতে তাঁর প্রেয়সীর ছবি দেখতে পান। যেন সে রঙিন গেলাসের কাঁচ-মহলাতে বন্দিনী। সে মহলা পার হয়ে হয়ে প্রেয়সীর কাছে পৌঁছেতে চান এবং চূড়ান্ত জবাব শুনতে চান।

    ভাববাদী দর্শনে এই শারাব হলো আল্লার ধ্যান। আর শারাব পান হলো- ধ্যানের মধ্য দিয়ে আল্লাহকে পাওয়ার সাধনা। সাকি হলো- আল্লার প্রেমের নামান্তর। আল্লাহকে না পাওয়ার হতাশ থেকে বেরিয়ে এসে, কবি তাঁর সাকিকে (জীবাত্মার প্রেম প্রদায়ী শক্তিরূপিণী সত্তা) বলেছেন- সাকি যেন আল্লাহকে পাওয়ার আরও সাধনার শক্তি (শারাব) প্রদান করে। এই শক্তি পার্থিব আঙুরজাত শারাব নয়, এ হলো হৃদয়ের গভীরে আলাহকে পাওয়া-না-পাওয়ার দ্বন্দ্ব ক্ষত-বিক্ষত বেদনা। আল্লাহ সাধক-কবির কাছে ধরা দিয়েও যেন অধরা থেকে যান। তাই কবির কাছে দিল্‌লাগী (তামাশা) মনে হয়। কিন্তু কবি হাল ছাড়েন না। তিনি বেহিসেবি শারাব  (সাধনার শক্তি) পানে মাতাল হন। পার্থিব জীবনের রঙিন নেশায় মশগুল হওয়াটা সুফিবাদীদের কাছে হারাম (অবৈধ, নিষিদ্ধ, অপবিত্র, পাপ), কিন্তু সাধনার মধ্য দিয়ে আল্লাকে  না-পাওয়ার বেদনাও কি বৈধ, পবিত্র? কবির এই বেদনার অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ে। শরিয়তিরা আনুষ্ঠানিকতার বিধিতে কবির এই সাধনাকে অসিদ্ধ বলে ভাবেন। এর ফলাফল অনন্ত নরকবাস। কবি হৃষ্টচিত্তে মেনে নিয়েই শরিয়তি বিধিকে বিদায় জানান। এত কিছুর পরে, আল্লার ধ্যনে মত্ত কবি সাধনার মধ্য দিয়ে তাঁর প্রিয়ার (আরাধ্য পরমস্রষ্টা) অস্তিত্ব অনুভব করেন। কবি নিজের ধ্যান-মগ্নতার মধ্য দিয়ে নিজেকেই সান্ত্বনা দেন-  মহল পার (সাধনার স্তর) হলেই তিনি আল্লার সন্ধান পাবেন, সেখানে তিনি তাঁর সকল প্রশ্নের জবাব পাবেন।

     
  • রচনাকাল: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। উল্লেখ্য, বঙ্গবাণী পত্রিকার 'জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ' সংখ্যায় (মে জুন ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দ) গানটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ২৮ বৎসর ১ মাস।
     
  • পত্রিকা:
    • বঙ্গবাণী। জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৪ (মে-জুন ১৯২৭)।
    • নওরোজ আষাঢ় ১৩৩৪ (জুন-জুলাই ১৯২৭)। নজরুল-কৃত স্বরলিপি।
  • গ্রন্থ:
    • বুলবুল
      • প্রথম সংস্করণ নভেম্বর ১৯২৮। কার্তিক ১৩৩৫। গান ৮। সিন্ধু কাওয়ালি।
      • নজরুল-রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড [বাংলা একাডেমী, ফাল্গুন ১৪১৩। ফেব্রুয়ারি ২০০৭। বুলবুল। গান ৮। সিন্ধু কাওয়ালি। পৃষ্ঠা: ১৫৬-১৫৭]
    • নজরুল-গীতিকা
      • প্রথম সংস্করণ। সেপ্টেম্বর ১৯৩০। ভাদ্র ১৩৩৭। পিলু-কাহারবা-দাদরা-তাল ফেরতা। গজল। ১৫। পৃষ্ঠা: ৭৩-৭৪।
      • নজরুল রচনাবলী, জন্মশতবর্ষ সংস্করণ। তৃতীয় খণ্ড [বাংলা একাডেমী, ঢাকা ফাল্গুন ১৪১৩/মার্চ ২০০৭।] নজরুল গীতিকা। ৬০। গজল।   সিন্ধু-কাওয়ালি। পৃষ্ঠা: ২১২]
      • সুরমুকুর। নলিনীকান্ত সরকার। নজরুল ইন্স্সটিটিউট ঢাকা ভাদ্র, ১৪১০ বঙ্গাব্দ/ আগষ্ট, ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দ।[নমুনা]
         
  • রেকর্ড: এইচএমভি। জানুয়ারি ১৯৩১ (পৌষ-মাঘ ১৩৩৭ বঙ্গাব্দ)। পি ১১৬৮৭। শিল্পী কাশেম মল্লিক[শ্রবণ নমুনা]
     
  • স্বরলিপি ও স্বরলিপিকার:
  • সুরকার: নজরুল ইসলাম
  • পর্যায়:

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।