বন-কুন্তল এলায়ে বন-শবরী ঝুরে সকরুণ সুরে। (bon-kuntol elaye bon-shobori)

বন-কুন্তল এলায়ে বন-শবরী ঝুরে সকরুণ সুরে।
বিষাদিত ছায়া তার চৈতালি সন্ধ্যার চাঁদের মুকুরে
        চপলতা বিসরি' যেন বন-যৌবন
         বিরহ-ক্ষীণ আজি উদাস উন্মন,
তোলে না ঝঙ্কার আর ঝরা পাতার মর্মর নূপুরে 
যে কুহু কুহরিত মধুর পঞ্চমে বিভোর ভাবে,
ভগ্ন কণ্ঠে তার থেমে যায় সুর করুণ রেখাবে।
        কোন্‌ বন-শিকারির অকরুণ তীর
        আলো হ'রে নিল ওই উজল আঁখির 

ফেলে যাওয়া বাঁশি তা'র অঞ্চলে লুকায়ে —
        গিরি-দরি-প্রান্তরে খোঁজে সে নিঠুরে

 

  • ভাবসন্ধান: গানটি নজরুল রচিত 'নব রাগমালিকা' গীতিনাট্যের প্রথম অনুষ্ঠানের পঞ্চম গান। কাজী নজরুল ইসলাম মূলত এই গানের ভিতরে বনকুন্তলা রাগের রূপ বর্ণনা করেছেন রূপকতার ভিতর দিয়ে। এই বিচারে এই গানটিকে বলা যায়- বনকুন্তলা রাগের রূপকাশ্রিত লক্ষণগীত। এই রাগের শুরুতে  নিবদ্ধ  'বন-কুন্তল এলায়ে বন-শবরী ঝুরে সকরুণ সুরে'- গানটির শুরুতে নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন-

'এই রাগিণীতে এলায়িত কুন্তলা বিরহিণী বন শবরী রূপ অরণ্যাশ্রয়ী লইয়া ফুটিয়া ওঠে বলিয়া ইহার নাম বনকুন্তলা। আরোহীতে পঞ্চম (পা) ধৈবত (ধা) অবলম্বন করিয়া স্থিতি বলিয়া ভূপালী হইতে স্বতন্ত্র শোনায়। আরোহীতে র্সা না ধা পা, গা রা সা রা- ইহার প্রধান রূপ, ইহাতেই ইহার অরণ্যাশ্রয়ী করুণ-রূপ ফুটে উঠে।'

গানটির স্থায়ীতে পাওয়া যায়, বিরহবিধূর করুণ রস। রাগের বিরহ-করুণ রসের প্রকাশ ঘটেছে বনচারিণী শবরকন্যার বিলাপ এবং সকরুণ সুরে। শবরকন্যার ব্যথিত মনের বিষাদিত ছায়া চৈতালি সন্ধ্যার চাঁদের আভাকে ম্লান করে দিয়েছে। অশান্ত-যৌবনের চপলতা বিসর্জন দিয়ে আজ সে বিরহ-বিষাদে ম্লান। সে আনমনা উদাস। এখন আর তার পায়ের চপল আঘাতে শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনি নূপুর নিক্কনের মতো ঝঙ্কার তোলে না।

বনকুন্তলা রাগের পরিচয় দিতে গিয়ে নজরুল উল্লেখ করেছিলেন 'আরোহীতে পঞ্চম (পা) ধৈবত (ধা) অবলম্বন করিয়া স্থিতি বলিয়া ভূপালী হইতে স্বতন্ত্র শোনায়।' কবি সঞ্চারীতে এসে সেই ভাবটি উপস্থাপন করেছেন। গানে বলা হয়েছে- হৃদয়বসন্তকাননে যে যৌবনের কোকিল কুহু পঞ্চম স্বরে উচ্ছলিত ছিল, তার সুর মলিন হয়ে ভগ্ন কণ্ঠে স্তিমিত হয়েছে। পঞ্চমের সুমধুর তীব্রতর আনন্দ ম্লান হয়ে শেষ হয়েছে রেখাব স্বরে। কবি স্বরের অবস্থানের ভিতর দিয়ে পঞ্চম থেকে রেখাবে অবনতিকে আনন্দের অবরোহ হিসেবে প্রকাশ করেছেন। কবির বর্ণনায় রাগের রূপ এবং কাব্যের রূপকতা একাকার হয়ে যায়। কিন্তু গানটির সুর-বিন্যাসেও দেখা যায় স র গ প ধ'র বিশেষ প্রয়োগ যেখানে ভূপালীর রাগ স্পষ্ট হয়ে উঠে, সেখান শুদ্ধ নিষাদ এবং চলনের বিশেষ কৌশলী স্বরবিন্যাসে ভূপালীকে ভুলিয়ে দেয় এবং সেখান থেকে বেরিয়ে আসে বনকুন্তলার বিশেষ রূপ। আভোগে এসে পাওয়া যায়, শবর-কন্যার হৃদয়ে প্রেমানুভুতির সঞ্চার করেছিল যে বন-শিকারি, তাঁর বিস্মৃতি শবরীকন্যার হৃদয়ে অকরুণ তীরের মতো ক্ষতবিক্ষত করেছে। তার অবর্তমানে শবরকন্যার চোখ প্রেমের আলো নিভে গেছে, উজ্জ্বল আঁখিতার হয়েছে ম্লান। তবু বন-শিকারির ফেলে যাওয়া বাঁশি শবরী সযত্নে আঁচলে লুকিয়ে রাখে। এর ভিতর দিয়ে তার প্রেমের স্পর্শ অনুভব করে। সে কী এক গভীর আশায় এখনও গিরি-নদী-প্রান্তরে তার প্রেমিককে খুঁজে মরে। গানের এই অংশেও বনকুন্তলার বিরহে পাওয়া যায় গভীর অভিমান, যা রাগের বিরহবিধূর করুণ রসকে উপস্থাপন করে।

টীকা

  • বন-কুন্তলা= বুনো চুল, অবিন্যস্ত চুল, পরিপাটিহীন চুল।
  • বন-শবরী=ভারতের অরণ্যচারী শবর জাতির কন্যা হিসেবে বন-শবরী শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।
  • চাঁদের মুকুর=চাঁদের আয়না। কবি কল্পনায়, যেন বিষাদের ছায়া চাঁদের আয়নায় ধরা পড়েছে।
  • বন-যৌবন=অরণ্যচারী নারী প্রবল যৌবন-চাপল্যকে বন-যৌবন (বুনো যৌবন উচ্ছাস) বলা হয়েছে।
  • বিরহ-ক্ষীণ=বিরহ দ্বারা ক্ষীণ
     
  • রচনাকাল ও স্থান: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ জানুয়ারি,  (সোমবার ২৯ পৌষ ১৯৪৭) সন্ধ্যা ৭.২০টায় কলকাতা বেতারকেন্দ্র থেকে নজরুল-সৃষ্ট রাগ নিয়ে তৈরি 'নব রাগমালিকা' গীতিনাট্যের প্রথম পর্ব প্রচারিত হয়েছিল। এই গানটি ছিল গীতিনাট্যের পঞ্চম গান। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ৪০ বৎসর ৭ মাস।
     
  • গ্রন্থ:
    • একশো গানের নজরুল স্বরলিপি, প্রথম খণ্ড (হরফ প্রকাশনী, পৌষ ১৪০৬। জানুয়ারি ২০০০।)। ৪৮ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা: ১১৭-১১৯।
    • নজরুল গীতি, অখণ্ড (আব্দুল আজীজ আল-আমান, সম্পাদিত)। নজরুল-সঙ্গীত সংগ্রহ (নজরুল ইনস্টিটিউট, মাঘ ১৪১৮। ফেব্রুয়ারি ২০১২)। ১৫৭৭ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা: ৪৭২-৪৭৩।
    • নবরাগ
      • নজরুল ইনস্টিটিউট। সেপ্টেম্বর ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দ)। ৮ম গান। পৃষ্ঠা: ১৮-২০।
      • হরফ প্রকাশনী। কবির ৭৩তম জন্মদিন, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ)। ৮ম গান। পৃষ্ঠা: ২৪-২৬। ন
      • সুনির্বাচিত নজরুল গীতির স্বরলিপি, পঞ্চম খণ্ড (সাহিত্যম্‌)। ৭ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা: ১৯-২১।
  • পত্রিকা:
    • বেতার জগৎ,১৬ জানুয়ারি, ১৯৪০ সংখ্যা 'নব রাগ মালিকা ১৩ জানুয়ারি, ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে শিল্পী ছিলেন গীতা মিত্র।
  • বেতার:
    • নব রাগমালিকা (গীতিনাট্য)। কলকাতা বেতারকেন্দ্র [১৩ জানুয়ারি ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দ (সোমবার ২৯ পৌষ ১৯৪৭) সন্ধ্যা ৭.২০টা] রাগ: বেণুকা (নজরুল-সৃষ্ট)। শিল্পী: গীতা মিত্র।
  • রেকর্ড: হিন্দুস্থান এস.এল এইচ ১১০। শিল্পী: দেবব্রত বিশ্বাস। [শ্রবণ নমুনা]
  • অন্যান্য শিল্পী: খায়রুল আনাম শাকিল (শ্রবণ নমুনা)
  • সুরকার: কাজী নজরুল ইসলাম
  • স্বরলিপিকার:
  • বিষয়াঙ্গ: নাট্যগীতি (প্রেম ও সঙ্গীত)
  • সুরাঙ্গ: খেয়ালাঙ্গ
  • গ্রহস্বর: ষড়্‌জ।

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।