বসন্ত মুখর আজি (boshonto mukhor aji)

বসন্ত মুখর আজি।
দক্ষিণ সমীরণে মর্মর গুঞ্জনে
বনে বনে বিহবল বাণী ওঠে বাজি'॥
অকারণ ভাষা তার ঝরঝর ঝরে
মুহু মুহু কুহু কুহু পিয়া পিয়া স্বরে,
পলাশ বকুলে অশোক শিমুলে ─
সাজানো তাহার কল-কথার সাজি॥
দোয়েল মধুপ বন-কপোত কূজনে,
ঘুম ভেঙে দেয় ভোরে বাসর শয়নে।
মৌনী আকাশ সেই বাণী-বিলাসে
অস্ত চাঁদের মুখে মৃদু মৃদু হাসে,
বিরহ-শীর্ণা গিরি-ঝর্ণার তীরে ─
পাহাড়ি বেণু হাতে ফেরে সুর ভাঁজি'॥

  • ভাবসন্ধান: গানটি রচিত হয়েছিল জগৎ ঘটকের রচিত জীবনস্রোত গীতি-আলেখ্যের জন্য। পরে বেতারে  হারামণির তৃতীয় অধিবেশনে 'রাগ: বসন্ত মুখারী' নামে প্রচারিত হয়েছিল। হারমণিতে প্রচারিত গানগুলোর মূলত রাগের ভাবগত রূপ বর্ণিত হলেও এই গানটিতে পাওয়া যায় নিটল বসন্তঋতুর বর্ণন। তার বোধ হয় অন্যতম কারণ হলো- গানটি হারামণির জন্য লেখা হয় নি। 

    বসন্তের আগমনে প্রকৃতিতে যে অপরূপ রূপবৈচিত্র্যের খেলা চলে, তারই নিটল চিত্র ফুটে উঠেছে এই গানে। কবি নন, যেন বসন্তই বহুরূপে বহু ভাষায় প্রকৃতিকে জানিয়ে দেয় 'বসন্ত মুখর আজি'। এই গানে কবি উপস্থাপক মাত্র।

    গানটির স্থায়ীর প্রথম পঙ্‌ক্তিতে 'বসন্ত মুখর' শব্দদ্বয়ের মধ্য দিয়ে বসন্তের উপস্থিতির ঘোষণা যেমন পাওয়া যায়, তেমনি রাগনাম 'বসন্তমুখারী' ইঙ্গিতবহ হয়ে ওঠে। স্থায়ীর বাকি দুই পঙ্‌ক্তিতে বসন্তের উপস্থিতির কথা জানিয়েছেন। কবি মনে করেন যে,- দখিনা বাতাসে, শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনিতে, বনে বনে ছড়িয়ে পড়েছে বসন্তের উৎসব-বার্তা।

    অন্তরাতে কবি বসন্তের উৎসব-বার্তাকে তুলে এনেছেন নানা উপমায়। কবি মনে করেন বসন্তের উৎসব-বার্তা, বর্ণ-গন্ধ-ধ্বনিতে বাঙ্ময় হয়ে প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়ছে বসন্তের কথা। তিনি বসন্তের সরব উৎসব-বার্তা খুঁজে পেয়েছেন কোকিলের  মুহুমুহু মধুর ধ্বনিতে। খুঁজে পেয়েছেন পলাশ, বকুল, অশোক, শিমুল ফুলের বর্ণাঢ্য সাজের ভিতরে। এসবই কবির কাছে যেন বসন্তের উৎসবমুখর অঙ্গনে বসন্তের অকারণ বাণীর বর্ষণ।

    কবি বসন্তের উৎসব-বার্তা অনুভব করেন ভোরের বাসর-ভাঙানিয়ায় দোয়েল, মৌমাছি, বন-কপোতের ধ্বনিতে। বসন্তের সে মধুর বাণী-রঙ্গে সহভাগী হয়ে ওঠে মৌন আকাশ, রাত্রি শেষে অস্তাগত পাণ্ডুর চাঁদের মুখে ছড়িয়ে পড়ে মৃদু হাসি, বর্ষণ-বিহীন বিরহী পাহাড়ি ঝর্নার তীরের বনাঞ্চলে। সমগ্র বনাঞ্চলে যেন বসন্ত তার মধুর সৌন্দর্যবেণু হাতে ঘুরে বেড়ায়। সব মিলিয়ে বসন্ত মুখর হয়ে ওঠে। বসন্ত মুখারী'র সে সুরবাণীর যেমন বসন্ত-উৎসবের বাহন মাত্র।
     
  • রচনাকাল ও স্থান:   গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু যায় নি। ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের  ২৭ ফেব্রুয়ারি (বৃ্হস্পতিবার ১৪ ফাল্গুন ১৩৪২), জগৎঘটকের রচিত জীবনস্রোত গীতি-আলেখ্য, কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়। এই নাটকে এ গানটি প্রথম ব্যবহৃত হয়েছিল। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ৩৬ বৎসর ৯ মাস।
     
    • উল্লেখ্য, মনোরঞ্জন সেনের 'সঙ্গীত স্রষ্টা নজরুল' প্রবন্ধ থেকে জানা যায় যে, নজরুল ইসলাম রাগ-রাগিণীর এই বৃহৎ ভাণ্ডার গড়ে তুলেছিলেন বিভিন্নভাবে। গ্রামোফোন কোম্পানীতে তিনি ওস্তাদ জমিরুদ্দীন খানের সান্নিধ্যে আসেন এবং কার্যত তাঁর শিষ্বত্ব গ্রহণ করেন। মুর্শিদাবাদ-নিবাসী ওস্তাদ কাদের বক্স ও মঞ্জু সাহেবের নিকটও তিনি বহু রাগ-রাগিণী আয়ত্ত করেন। ঠাকুর নবাব আলী চৌধুরী প্রণীত সঙ্গীত-পুস্তক থেকে তিনি বহু অপ্রচলিত ও লুপ্তপ্রায় রাগ-রাগিণীর হদিস পান। উদাহরণ হিসেবে লঙ্কাদহন-সারং রাগটি ধরা যায়। এই রাগে তিনি এই গানটি রচনা করেছিলেন।
              [সূত্র: মনোরঞ্জন সেন, সঙ্গীত স্রষ্টা নজরুল, সুধিজনের দৃষ্টিতে নজরুল সঙ্গীত, পৃষ্ঠা-১৫৬]
       
  • বেতার:
    • জীবনস্রোত [গীতি-আলেখ্য।  রচনা জগৎঘটক। কলকাতা বেতার কেন্দ্র। বৃহস্পতিবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬। ১৪ ফাল্গুন ১৩৪২। সান্ধ্য অনুষ্ঠান: ৮.৩০-৯.১৪ মিনিট
      • সূত্র:
        • বেতার জগৎ। সপ্তম বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা।পৃষ্ঠা ১৭২
        • The Inidian Listener font size.4.Vol I No 4, Page 232
    • হারামণি-৩। রাগ: বসন্ত মুখারী। কলকাতা বেতার কেন্দ্র। বুধবার, ১৩ ডিসেম্বর ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দ (২৭ অগ্রহায়ণ ১৩৪৬)। শিল্পী: কাজী নজরুল ইসলাম
      • সূত্র:
        • বেতার জগৎ পত্রিকার ১০ম বর্ষ ২৩শ সংখ্যা। পৃষ্ঠা: ৯২৬
        • The Indiann-Listener. 22 november 1939- Vol-IV-23 Page 1650
  • পত্রিকা:
    • কবিতা [কার্তিক-পৌষ ১৩৫১ বঙ্গাব্দ (নভেম্বর ১৯৪৪)। বসন্ত মুখারী-তেতালা]
    • বেতার জগৎ [১ মারচ, ১৯৫৯ সংখ্যা (১৬ ফাল্গুন ১৩৬৫)]
       
  • সুরকার:  বেতার জগৎ [১ মারচ, ১৯৫৯ সংখ্যা (১৬ ফাল্গুন ১৩৬৫)] সংখ্যায় গানটির সুরকারের নাম প্রকাশিত হয়েছিল-  শৈলেশ দত্তগুপ্ত। ব্রহ্মমোহন ঠাকুরের সংকলিত 'নজরুল-সঙ্গীত, আদি স্বরলিপি সংগ্রহ‌' (নজরুল ইনস্টিটিউট, আশ্বিন ১৪০৬। অক্টোবর ১৯৯৯) গৃহীত এই গানের স্বরলিপির শেষে লিখেছেন-

    [ নিঃসন্দেহে গানটির সুরকার নজরুল। ১৩. ১২. ১৯৩৯ তারিখে কলকাতা বেতার কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত 'হারামনি'র গান হিসাবে প্রচারিত হয়েছিল 'বসম্তমুখারী' রাগের নিদর্শন হিসাবে। বর্তমান স্বরলিপিটি 'বসন্ত-মুখারী' রাগ অনুসারেই রয়েছে। মূল সুরটি আজও অজানা । তবে কোন ভাবেই শৈলেশ দত্তগুপ্ত সুরকার হতে পারেন না। সম্ভবতঃ নজরুলের সুরটি তিনি স্মৃতি হতে উদ্ধার করেছিলেন। ১. ৩. ১৯৫৯ সংখ্যার বেতার জগতে প্রকাশিত হয় এই স্বরলিপি। পরে কাজী অনিরুদ্ধ তাঁর স্বরলিপি পুস্তকে এই স্বরলিপিটি অন্তর্ভুক্ত করেন। বোঝা যায় যে নজরুলের সুর, তাঁরই সহচরগণ, নিজেদের নামে প্রচারে মাঝে মাঝে উৎসাহী হতেন- সম্পাদক।]

  • স্বরলিপিকার:
    • ব্রহ্মমোহন ঠাকুর। [নজরুল-সঙ্গীত, আদি স্বরলিপি সংগ্রহ (নজরুল ইনস্টিটিউট, আশ্বিন ১৪০৬। অক্টোবর ১৯৯৯) -এর ১১ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা: ২৭-২৯।]  [নমুনা]
       
  • বিষয়াঙ্গ: প্রকৃতি [বসন্ত]
  • সুরাঙ্গ: খেয়ালঙ্গ।
    • রাগ: বসন্ত মুখারী।
    • তাল: ত্রিতাল।
    • গ্রহস্বর: সা

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।