কি হবে লাল পাল তু’লে ভাই (ki hobe lal pal tule vai)
কি হবে লাল পাল তু’লে ভাই ‘সাম্পানের’ উপর।
তোর পালে যত লাগ্বে হাওয়া রে
ও ভাই ঘর হবে তোর ততই পর॥
তোর কি দুঃখ হায় ভুলতে চাস্ ভাই, ছেঁড়া পাল রাঙিয়ে,
এবার পরান ভ’রে কে’দে নে তুই অগাধ জলে নেয়ে’
তোর কাঁদনে উঠে আসুক রে ঐ নদীর থেকে বালুর চর॥
তুই কিসের আশায় দিবি রে ভাই কূলের পানে পাড়ি,
তোর দীয়া সেথা না জ্বলে ভাই আঁধার যে ঘর-বাড়ি।’
তুই জীবন-কুলে পেলি নে তায় রে এবার মরণ-জলে তালাস কর্॥
- ভাবসন্ধান: রূপকতা ও প্রতীকের মাধ্যমে গভীর এক আধ্যাত্মিক জীবনদর্শন উপস্থাপিত হয়েছে এই গানে। অসীম কালস্রোতে (বিশ্ব-জীবনধারা) ভেসে চলে মানুষের জীবনতরী-রূপী সাম্পান। মানুষের অস্তিত্ব, তার দুঃখ, ব্যর্থতা যখন আশাহীন ভগ্ন-তরী হয়ে ওঠে, তখন তার একমাত্র পরমাশ্রয় হয়ে ওঠে পরমসত্তার কাছে জীবনশেষের শেষ-সমর্পণ।
মানুষের কল্প-ভাবনাশ্রিত লালাসায়, আশার রঙিন পাল তুলে ভেসে বেড়ায়। সাম্পানকে পূর্ণ করে চলে লোভ-লালসার সম্পদে। কিন্তু মানুষের প্রকৃত আশ্রয়স্থল হলো- পরমসত্তার কাছে লোভ-লালসাহীন সমর্পিত ঘর। তাই জগৎ-সংসারের জীবনতরীকে যতই বর্ণাঢ্য করার চেষ্টা করা হয়, ততই সে তার প্রকৃত ঘর থেকে দূরে সরে যায়।
ঘর সাজানোর লোভে মানুষ তাঁর জীবনতরীকে দুঃখময় করে তোলে। সামগ্রিক যাপিত জীবনে তাঁর স্বপ্নের ঘরকে ধরে রাখতে গিয়ে এক সময় উপলব্ধি করে সাজানো সংসার কখন হয়ে গেছে ভগ্ন-সংসার। মানুষ সে সংসারের ছেঁড়া পাল রাঙিয়ে তার অতৃপ্ত বাসনা অপূরণের দুঃখ ভুলতে চায়। কবি মনে করেন- ভগ্ন সংসারের ক্লান্তিকর জীবনকে নতুন করে সাজিয়ে কোনো লাভ নেই। তার চেয়ে অগাধ দুঃখের অশ্রুতে ভিজে নিজেকে লোভমুক্ত করাই শ্রেয়। সেই কান্নাই হৃদয়কে নির্মল করবে। অকূল সাগরের বুকে উঠে আসবে আশার বালুচর (আশার দ্বীপ)।
কবির প্রশ্ন - মানুষের জীবনের লক্ষ্য কি? আর তা যদি জানা না থাকে, তাহলে কিসের আশায় বৃথা কূলের খোঁজ করা। মানুষের লক্ষবিহীন গন্তব্য নিয়ে যায় আশা-প্রদীপহীন অন্ধকার আবাসের দিকে। যাপিত এই জীবনে পরম আশ্রয় না পেলেও, হয়তো মৃত্যুতে মিলবে পরমসত্তার পরমাশ্রয়।
- রচনাকাল ও স্থান: গানটি সওগাত পত্রিকার ফাল্গুন ১৩৩৫ বঙ্গাব্দ, সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। এই সময় নজরুল চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলেন। ব্রহ্মমোহন ঠাকুর তাঁর নজরুল সঙ্গীত নিরদেশিকা গ্রন্থে গানটি রচনার স্থান ও তারিখ উল্লেখ করেছেন- চট্টগ্রাম '২৪.১.১৯২৯' বৃহস্পতিবার, ১১ মাঘ ১৩৩৫)। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ২৯ বৎসর ৭ মাস।
- গ্রন্থ
- চোখের চাতক।
- প্রথম সংস্করণ [কার্তিক ১৩৩৬ বঙ্গাব্দ। গান ২২। ভাটিয়ালি-কার্ফা]
- নজরুল-রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড [বাংলা একাডেমী, ফাল্গুন ১৪১৩। ফেব্রুয়ারি ২০০৭। চোখের চাতক। গান ২২। ভাটিয়ালি-কার্ফ। পৃষ্ঠা: ২০৯-২১০।]
- চোখের চাতক।
- ঝড়
- প্রথম সংস্করণ [১৩৬৭ বঙ্গাব্দের ১ অগ্রহায়ণে (১৭ নভেম্বর ১৯৬০)। শিরোনাম: সাম্পানের গান (পূর্ববঙ্গের ভাটিয়ালি সুরে) ২।]
- নজরুল রচনাবলী ষষ্ঠ খণ্ড [জ্যৈষ্ঠ ১৪১৯, জুন ২০১২। ঝড়। শিরোনাম: সাম্পানের গান (পূর্ববঙ্গের ভাটিয়ালি সুরে) ২। পৃষ্ঠা ১৪৩-১৪৪]
- পত্রিকা:
- বুলবুল (ফাল্গুন ১৩৪৩ (মার্চ-এপ্রিল ১৯৩৭)। শিরোনাম: চট্টল গীতিকা।
- পর্যায়:
- বিষয়াঙ্গ: ধর্মসঙ্গীত। সাধারণ। পরমসত্তা। আশ্রয়