বিরূপ আঁখির কি রূপই তুই আঁকলি হৃদয় পটে (birup akhir ki rup e tui akli)

বিরূপ আঁখির কি রূপই তুই আঁকলি হৃদয় পটে,
চাঁদের পাশে আগুন জ্বলে যাহার ললাট তটে॥
সে সোনার অঙ্গে ভস্ম মাখিয়ে
বেড়িয়ে বেড়ায় সাপ নাচিয়ে;
এই ভবঘুরে বেদে নিয়ে তোর কলঙ্ক না রটে॥
ঘটে ইহার বুদ্ধি হতে সিদ্ধি অনেক বেশি,
বিষ খেয়ে এর প্রশান্ত মুখ লীলা এ কোন্‌ দেশী,
আপনারে যে করে হেলা
তার সনে তোর একি খেলা,
তুই দেখলি কোথায় আত্মভোলা এই সে তরুণ নটে॥

  • ভাবসন্ধান: মন্মথ রায়ের রচিত 'সতী ' নাটকের এই গানটিতে মহাদেবের রূপ-মহিমা বর্ণিত হয়েছে সতীর সখী বিজয়ার মুখে। সতী গোপনে মহাদেবের ছবি আঁকেন। বিজয়া সন্ধেহ করেন যে,- সতী মহাদেবের প্রেমাসক্ত। বিজয়া  এই প্রেম থেকে বিরত থাকার কৌশল হিবে সতীর কাছে মহাদেবের যে রূপ বর্ণনা করেন, আপাত দৃষ্টিতে তা কদর্য, কিন্তু এই বর্ণনার ভিতরের রয়েছে মহাদেবের রূপ মহিমা। এই গানটিতে মহাদেবের রূপ বর্ণনা করা হয়েছে- সন্ধ্যভাষার আলো ছায়ার খেলা। আবার এই বর্ণনায় রয়েছে- রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের অন্নদমঙ্গল কাব্যের 'অন্নদার ভবানন্দ ভবনে যাত্রা' অংশে বর্ণি মহাদেবের বর্ণনার ছায়া।  যেমন-

    "...অতি বড় বৃদ্ধ পতি সিদ্ধিতে নিপুণ
    কোন গুণ নাহি তার কপালে আগুন॥
    কুকথায় পঞ্চমুখ কণ্ঠে ভরা বিষ।
    কেবল আমার সঙ্গে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ॥
    গঙ্গা নামে সতা তার তরঙ্গ এমনি।
    জীবনস্বরূপা সে স্বামীর শিরোমনি॥
    ভূত নাচাইয়া পতি ফেরে ঘরে ঘরে।
    না মরে পাষান বাপ দিলা এমন বরে॥

    বিজয়া মহাদেবের রূপ বর্ণনার শুরুতেই বিস্ময় বা কতুহলে, সতীর কাছে প্রশ্ন রেখেছেন- যে দৃষ্টিনন্দন নয়, তাকে কি করে তার ছবি হৃদয় পটে আঁকলো সে। সন্ধ্যাভাষায় বিজয়া বলেন- 'চাঁদের পাশে আগুন যাহার জ্বলে ললাট তটে'। মূল অর্থ মহাদেবের মস্তকে থাকে চন্দ্র আর তারই পাশে থাকে তাঁর বহ্নিময় তৃতীয় চোখ থাকে কপালে।

    মহদেবের অঙ্গরূপকে বলা হয়েছে সোনার অঙ্গ। সে অঙ্গে  থাকে শ্মশানের ছাই ভস্ম।  ভবঘুরে বেদেদের মতো তার কণ্ঠ বেষ্টন করে থাকে সাপ। এর সাথে জড়িয়ে পড়লে কলঙ্ক ছাড়া সতীর আর কিছু জুটবে না, বিজয়ার এমনই ভাবনা। বিজয়া মনে করেন মহাদেবের মাথায় বুদ্ধির চেয়ে সিদ্ধি বেশি। এখানে সিদ্ধি শব্দটি দ্ব্যর্থক। সিদ্ধ হতে পারে মাদকদ্রব্য, হতে পারে সাধনায় সিদ্ধি লাভ অর্থে।

    বিজয়া বিস্মিত- বিষপান করেও কিভাবে এঁর মুখ প্রশান্ত অথচ লীলামায় রূপে অবিচল থাকে। উল্লেখ্য, এখানে পৌরাণিক কাহিনিতে বর্ণিত সমুদ্রমন্থন শেষে হলাহল নামক তীব্র বিষ পান করার পরও যিনি প্রশান্ত ছিলেন, সেই মহদেবের বিস্ময়কর রূপের কথা বলা হয়েছে।

    গানের শেষে বিজয়ার আক্ষেপ- যে নিজেকে অবহেলা করে, সে কী করে সতীর যত্ন নেবে!? বিজয়ার বিস্ময়- এমন ছন্নছাড়ার সাথে সতীর এ কী প্রেমের খেলা!  কোথায়্ এই আত্মভোলাকে তরুণ নটের (নায়ক) সাক্ষাৎ হলো সতীর সাথে- এটাও তাঁর কাছে বিস্মিত প্রশ্ন।

  • রচনাকাল ও স্থান: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ এপ্রিল (বুধবার, ১৫ বৈশাখ ১৩৪৪), মন্মথ রায়ের রচিত 'সতী '  নাটক  নাট্যনিকেতন নামক রঙ্গালয়ে মঞ্চস্থ হয়। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ৩৭ বৎসর ১১ মাস।
     
  • মঞ্চ নাটক: সতী (নাটক)। রচয়িতা মন্মথ রায় । [নাট্যনিকেতন। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ এপ্রিল (বুধবার, ১৫ বৈশাখ ১৩৪৪)। চরিত্র: বিজয়া। শিল্পী: দুর্গারাণী। সুর: নজরুল ইসলাম]
  • গ্রন্থ:
    • 'সতী ' । নাটক। প্রথম অঙ্ক। প্রথম দৃশ্য। সখীদের গান। মন্মথ রায়  নাট্য গ্রন্থাবলী। ষষ্ঠ খণ্ড। মনমথন প্রকাশন। ১৩৬৫ বঙ্গাব্দ (১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দ)। পৃষ্ঠা: ২১৭
    • নজরুল-সঙ্গীত সংগ্রহ [নজরুল ইন্সটিটিউট, ফেব্রুয়ারি ২০১১। গান সংখ্যা ২০৭৮।
  • পর্যায়:
    • বিষয়াঙ্গ: ধর্মসঙ্গীত। সনাতন হিন্দধর্ম। শাক্ত। মহাদেব। রূপ বর্ণন।

 

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।