মদালস ময়ূর-বীণা কার বাজে।
মদালস ময়ূর-বীণা কার বাজে।
অরুণ-বিভাসিত অম্বর মাঝে॥
কোন্ মহামৌনীর ধ্যান হ'ল ভঙ্গ?
নেচে' ফেরে অশান্ত মায়া-কুরঙ্গ,
তপোবনে রঙ্গে অনঙ্গ বিরাজে॥
নিদ্রিত রুদ্রের ললাট-বহ্নি,
পাশে তা'র নেচে ফেরে বনমালা তন্বী।
বিজড়িত জটাজুটে খেলে শিশু শশী
দেয় মালা-চন্দন ভীরু উর্বশী,
শঙ্কর সাজিল রে নটরাজ-সাজে॥
- ভাবার্থ: গানটিতে পাওয়া সৌরাষ্ট্র ভৈরবের ভাবগত দর্শন। সাঙ্গীতিক শ্রেণিকরণের বিচারে, এই রাগটি ভৈরব অঙ্গের একটি রাগ প্রকরণ। পৌরাণিক দর্শনের বিচারে বহুরূপী ভৈরবের (শিব) একটি বিশেষ রূপ- যার নাম 'সৌরষ্ট্র ভৈরব'। কবি সৌরাষ্ট্র ভৈরবকে পৌরাণিক দর্শন এবং রাগের নান্দনিক দর্শনের সংমিশ্রণে সান্ধ্যভাষার আশ্রয়ে গানটি রচনা করেছিলেন।
এই রাগের চল মদালস (মদপানের আবেশে বিহবল দশা)। অর্থাৎ এই গানের চলনে রয়েছে মোহনীয় মদির ভাব। এই রাগটি প্রাতঃকালে গেয়। রাত্রির অন্ধকার অপসারিত করে ভোরের সূর্যের মতো এই রাগ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। কবির ভাষায় তাই এই রাগ 'অরুণ-বিভাসিত অম্বর মাঝে'-এর মতো উপস্থাপিত হয়।
এই রাগের চলনে চঞ্চল্য আছে, যা ক্ষণে ক্ষণে চিত্তলোকে আলোড়িত করে বটে কিন্তু বিক্ষুব্ধ করে না। কবি রাগের এই চঞ্চলরূপকে তুলনা করেছেন নৃত্যরতা অনঙ্গ (অঙ্গহীন, দৈহিক রূপ বর্জিত) মায়া হরিণী চাঞ্চল্যের সাথে। এই রাগের উপস্থাপনে রাত্রি শেষে প্রকৃতি যেন জেগে ওঠে 'মৌন মুনির ধ্যানমগ্ন' দশা থেকে। যেন সৌরাষ্ট্র ভৈরবের মাদকীয় উচ্ছলিত চলনে প্রকৃতি জেগে উঠে গভীর সুপ্তি থেকে।
সৌরাষ্ট্র ভৈরবের সৌন্দর্য রুদ্র ভৈরবের মতো প্রকট নয়। বরং এই রাগের চলনে রয়েছে যেন বনমালা পরিহিতা তরুণীর নৃত্যানন্দের পদছন্দ। যা উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে অনিন্দ্য সৌন্দর্যে মোহে। এ রাগের আভা পূর্ণচাঁদের মতো প্রখর নয় বরং শিশু চাঁদের কিরণের মতি অতি কোমল স্নিগ্ধ। জটাজুটে খেলে বলতে কবি সম্ভবত রাগের বিস্তারের রূপকে তুলে ধরতে চেয়েছেন। এই রাগে পাওয়া যায় ভক্তি ও শৃঙ্গার রসের আভাষ। এই গানের স্বর্গ-সুন্দরী ভীরু উর্বশী নিজেকে নিবেদন করেন প্রেম-সৌন্দর্যের মালা-চন্দন দিয়ে। এই নিবেদনে রুদ্র ভৈরব হয়ে ওঠেন নটরাজ শিব। আভোগের শেষের কয়েকটি চরণে এই রাগটির ভক্তি ও শৃঙ্গারে একটি মিশ্ররূপকে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই উভয় রসের স্নাত এই রাগের পরিবেশনার ভক্তিতে প্রাপ্তির দর্শন নেই, আবার শৃঙ্গারের ভোগেরও ইঙ্গিত নেই। এই রাগে রয়েছে উভয় রসের মিশ্রণে সৃষ্টি কল্পবাস্তবের ভিন্নতর রসাবেশ।
- রচনাকাল ও স্থান: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ৮ জানুয়ারি (২৩ পৌষ ১৩৪৬) 'হারামণি' নামক অনুষ্ঠানের চতুর্থ অধিবেশনে গানটি প্রথম সম্প্রচারিত হয়েছিল। এই সময় নজরুল ইসলামের বয়স ছিল ৪০ বৎসর ৭ মাস।
- গ্রন্থ:
- শেষ সওগাত
- প্রথম সংস্করণ [২৫শে বৈশাখ ১৩৬৫ (বৃহস্পতিবার, ৪ মে ১৯৫৮)। ছন্দিতা। সৌরাষ্ট্র ভৈরব-তেতালা (বাদী মধ্যম)]
- নজরুল রচনাবলী ষষ্ঠ খণ্ড [জ্যৈষ্ঠ ১৪১৯, জুন ২০১২। শেষ সওগাত। ছন্দিতা। সৌরাষ্ট্র ভৈরব-তেতালা (বাদী মধ্যম)। পৃষ্ঠা ১২১]
- নজরুল-সঙ্গীত সংগ্রহ [নজরুল ইনস্টিটিউট ফেব্রুয়ারি ২০১২। গান সংখ্যা ১৬৭২। রাগ: সৌরাষ্ট্র ভৈরব, তাল: ত্রিতাল। পৃষ্ঠা: ৪৯৯]
- একশো গানের নজরুল স্বরলিপি, দশম খণ্ড, (হরফ প্রকাশনী, পৌষ ১৪০৬। জানুয়ারি ২০০০) -এর ৩৭ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা: ৯৬-৯৭।
- নজরুল গীতি, অখণ্ড (আব্দুল আজীজ আল-আমান, সম্পাদিত)। [হরফ প্রকাশনী, মাঘ ১৪১০। জানুয়ারি ২০০৪]। রাগ-প্রধান গান। গান-৯২৭। পৃষ্ঠা: ২৩২।
- শেষ সওগাত
- বেতার:
- হারামণি-৪। রাগ: সৌরাষ্ট্র ভৈরব । কলকাতা বেতার কেন্দ্র। ৮ জানুয়ারি ১৯৪০ (২৩ পৌষ ১৩৪৬))। শিল্পী-নজরুল।
- সূত্র: বেতার জগৎ পত্রিকার ১১শ বর্ষ ১ম সংখ্যা। পৃষ্ঠা: ৩৭
- ষট ভৈরব (ছয়টি ভৈরব অঙ্গের রাগ নিয়ে সৃষ্ট সঙ্গীতানুষ্ঠান)। ১৩ জুলাই ১৯৪১ (রবিবার ২৯ আষাঢ়। ১৩৪৮)। প্রচার সময়: ৮.২৫-৯.০৪। শিল্পী-শৈল দেবী।
- সূত্র:
- বেতার জগৎ [১২শ বর্ষ ১৩শ সংখ্যা, মঙ্গলবার, ১ জুলাই ১৯৪১, ১৭ আষাঢ় ১৩৪৮ পৃষ্ঠা ৭৭৮]
- The Indiann-Listener [22 Sepetember 1939/Vol. VI No. 13. Page 79]
- সূত্র:
- হারামণি-৪। রাগ: সৌরাষ্ট্র ভৈরব । কলকাতা বেতার কেন্দ্র। ৮ জানুয়ারি ১৯৪০ (২৩ পৌষ ১৩৪৬))। শিল্পী-নজরুল।
- সঙ্গীতবিষয়ক তথ্যাবলি:
- সুরকার: কাজী নজরুল ইসলাম
- স্বরলিপিকার: ড. ব্রহ্মমোহন ঠাকুর। [একশো গানের নজরুল স্বরলিপি, দশম খণ্ড, (হরফ প্রকাশনী, পৌষ ১৪০৬। জানুয়ারি ২০০০) -এর ৩৭ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা: ৯৬-৯৭।]
- বিষয়াঙ্গ: সঙ্গীত-সন্দর্শন
- সুরাঙ্গ: খেয়ালাঙ্গ
- রাগ: সৌরাষ্ট্র ভৈরব
- তাল: ত্রিতাল
- গ্রহস্বর: সা।