অগ্নি-গিরি ঘুমন্ত উঠিল জাগিয়া [ogni- giri ghumonto uthilo jagiya]

অগ্নি-গিরি ঘুমন্ত উঠিল জাগিয়া।
বহ্নি-রাগে দিগন্ত গেল রে রাঙিয়া॥
রুদ্র রোষে কি শঙ্কর ঊর্ধ্বের পানে
লক্ষ-ফণা ভুজঙ্গ-বিদ্যুৎ হানে
দীপ্ত তেজে অনন্ত-নাগের ঘুম ভাঙিয়া॥
লঙ্কা-দাহন হোমাগ্নি সাগ্নিক মন্ত্র
যজ্ঞ-ধূম বেদ-ওঙ্কার ছাইল অনন্ত।
খড়গ-পাণি শ্রীচণ্ডী অরাজক মহীতে
দৈত্য নিশুম্ভ-শুম্ভে এলো বুঝি দহিতে,
বিশ্ব কাঁদে প্রেম-ভিক্ষু আনন্দ মাগিয়া॥

  • ভাবসন্ধান: ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ফেব্রুয়ারি তারিখে কলকাতা বেতার থেকে প্রথম প্রচারিত হয়েছিল জগৎঘটক রচিত 'জীবনস্রোত' গীতি-আলেখ্যে। প্রথম ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ৬ এপ্রিল প্রথম প্রচারিত ‘সারঙ্গ রঙ্গ’ গীতি-আলেখ্যের প্রথম প্রচারের দ্বিতীয় গান।

    ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ২রা ফেব্রুয়ারি বেতার জগত পত্রিকায় এই গীতি-আলেখ্য সম্পর্কে বলা হয়েছিল-

    'জীবনস্রোতে গানের ভিতর দিয়ে যে দার্শনিকতার সূচনা করা হয়েছে তা রসিক মনকে স্পর্শ করবে বলে আমার ধারণা'। সম্ভবত কবি এমনি একটি জীবনদর্শনকে উপস্থাপন করেছেন- 'বিশ্ব কাঁদে প্রেম-ভিক্ষু আনন্দ মাগিয়া' পংক্তিতে। হয়তো কবি শান্তিবিঘ্নকারী সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মধ্য খুঁজে পেতে চেয়েছেন প্রবহমান জীবনস্রোতের আনন্দ-বেদনা। জগতসংসারের সুপ্ত হিংসা-বিদ্বেষ কখনো কখনো অনিবার্যভাবে জেগে উঠে সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো। জগত-সংসার যখন হিংসা-বিদ্বেষের তীব্রদহনে উৎপীড়িত হয়,তখন আনন্দের প্রত্যশায় বিশ্বজগৎ প্রেম-ভিক্ষু হয়ে বিলাপ করে।

    গানটিতে ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি সক্রিয় হওয়ার বিবরণ দেওয়া হয়েছে, জীবনস্রোতের সমান্তরাল অনুভবকে প্রচ্ছন্ন রেখে। গানটির স্থায়ীতে ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের প্রথম অগ্নি উদ্গীরণের আভাষ পাই। যার প্রভাবে দিগন্ত অগ্নিবর্ণে রঞ্জিত হয়ে। কবি অগ্ন্ন্যুৎপাতের ভয়ঙ্কর রূপকে পৌরাণিক রূপকতার মধ্য দিয়ে উপস্থাপন করেছেন। যেন ঘুমন্ত অনন্ত নামক পৌরাণিক নাগ মহাদেবের তীব্র ক্রোধের প্রভাবে জেগে উঠেছে,আর তার লক্ষ ফণা তীব্র তেজ আগ্নেয় জ্বালামুখ দিয়ে তেজ উদ্গীরণ করছে।

    রাম-রাবণের যুদ্ধে রাবণের রাজধানী লঙ্কা সাগ্নিক মন্ত্রে দাহিত হয়েছিল। সেই ধ্বংসযজ্ঞের উচ্চারিত বেদমন্ত্রের তেজ এবং যজ্ঞের ধোঁয়ার সাথে আগ্নেয়গিরির বিধ্বংসীরূপের তুলনা করেছেন। কবি এই গানের বাণীতে রাগ লঙ্কাদাহন নামটিকে অপূর্ব কৌশলে ব্যবহার করেছেন । আভোগে আগ্নেয়গিরির রূপ ভয়ঙ্করী শ্রীচণ্ডীর তেজদীপ্ত রূপের রূপকতায় উঠে এসেছে। উল্লেখ্য, হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী মতে- দেবী দুর্গা শ্রীচণ্ডীর ভয়ঙ্করী এবং মোহনীয়া রূপ ধরে শুম্ভ-নিশুম্ভ নামক দুই দৈত্যকে হত্যা করেছিলেন। কবি নান্দনিক রূপকতায় শ্রীচণ্ডীর সে ভয়ঙ্কর-সুন্দর (সাবলাইম)-কেই উপস্থাপন করেছেন অপূর্ব রূপকতায়।

    গানটি লঙ্কাদাহন সারং রাগে ত্রিতালে নিবদ্ধ। সুরাঙ্গের বিচারে খেয়ালাঙ্গ।

  • রচনাকাল ও স্থান: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু যায় নি। ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ ফেব্রুয়ারি (বৃ্হস্পতিবার ১৪ ফাল্গুন ১৩৪২), জগৎঘটকের রচিত জীবনস্রোত (গীতি-আলেখ্য, কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়। এই নাটকে এ গানটি প্রথম ব্যবহৃত হয়েছিল। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ৩৬ বৎসর ৭ মাস।

    উল্লেখ্য, মনোরঞ্জন সেনের 'সঙ্গীত স্রষ্টা নজরুল' প্রবন্ধ থেকে জানা যায় যে, নজরুল ইসলাম রাগ-রাগিণীর এই বৃহৎ ভাণ্ডার গড়ে তুলেছিলেন বিভিন্নভাবে। গ্রামোফোন কোম্পানীতে তিনি ওস্তাদ জমিরুদ্দীন খানের সান্নিধ্যে আসেন এবং কার্যত তাঁর শিষ্বত্ব গ্রহণ করেন। মুর্শিদাবাদ-নিবাসী ওস্তাদ কাদের বক্স ও মঞ্জু সাহেবের নিকটও তিনি বহু রাগ-রাগিণী আয়ত্ত করেন। ঠাকুর নবাব আলী চৌধুরী প্রণীত সঙ্গীত-পুস্তক থেকে তিনি বহু অপ্রচলিত ও লুপ্তপ্রায় রাগ-রাগিণীর হদিস পান। উদাহরণ হিসেবে লঙ্কাদহন-সারং রাগটি ধরা যায়। এই রাগে তিনি এই গানটি রচনা করেছিলেন। [সূত্র: মনোরঞ্জন সেন, সঙ্গীত স্রষ্টা নজরুল, সুধীজনের দৃষ্টিতে নজরুল সঙ্গীত, পৃষ্ঠা-১৫৬]

     
  • পত্রিকা: ভারতবর্ষ। বৈশাখ ১৩৪৭ (এপ্রিল- মে ১৯৪০)। স্বরলিপিকার-জগৎ ঘটক। সুর-নজরুল ইসলাম। রাগ: লঙ্ক-দহন সারং। তেতালা [নমুনা]
  • বেতার:
    • জীবনস্রোত [গীতি-আলেখ্য।  রচনা জগৎঘটক। কলকাতা বেতার কেন্দ্র। বৃহস্পতিবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬। ১৪ ফাল্গুন ১৩৪২। সান্ধ্য অনুষ্ঠান: ৮.৩০-৯.১৪ মিনিট
        [সূত্র:
      • বেতার জগৎ। সপ্তম বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা। ১৬ ফেব্রুয়ারি. ১৯৩৬ [পৃষ্ঠা ১৭২]
      • The Inidian Listener পত্রিকার ৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬ সংখ্যা। পৃষ্ঠা ২৩২]
    • সারঙ্গ রঙ্গ (গীতি আলেখ্য. সারঙ্গ অঙ্গের রাগভিত্তিক অনুষ্ঠান)                
      • প্রথম প্রচার: কলকাতা বেতার কেন্দ্র। ৬ এপ্রিল ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দ (শনিবার ২৪ চৈত্র ১৩৪৬), সান্ধ্য অনুষ্ঠান। সন্ধ্যা ৭.১৫-৭.৫০ মিনিট। শিল্পী: শৈল দেবী [পাণ্ডুলিপি]
          [সূত্র: বেতার জগৎ-এর ১১শ বর্ষ, ৭ম সংখ্যা অনুষ্ঠান সূচী। পৃষ্ঠা: ৩৪০, ৩৬৯]
      • দ্বিতীয় প্রচার: কলকাতা বেতার কেন্দ্র। ২৩ নভেম্বর ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দ (শনিবার ৭ অগ্রহায়ণ ১৩৪৭)। তৃতীয় অধিবেশন। ৮.০০-৮.৩৯।
           [সূত্র: বেতার জগৎ। ১১শ বর্ষ ২২ সংখ্যা। পৃষ্ঠা: ১২৮৬
  • স্বরলিপিকার ও স্বরলিপি: জগৎ ঘটক। ভারতবর্ষ। বৈশাখ ১৩৪৭। এপ্রিল- মে ১৯৪০ [নমুনা]
  • পর্যায়:

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।