কেন কাঁদে পরান কি বেদনায় কারে কহি (keno kande poran ki bedonay kare kohi)
কেন কাঁদে পরান কি বেদনায় কারে কহি।
সদা কাঁপে ভীরু হিয়া রহি' রহি'॥
সে থাকে নীল নভে আমি নয়ন-জল-সায়রে
সাতাশ তারার সতীন-সাথে সে যে ঘুরে মরে
কেমনে ধরি সে চাঁদে রাহু নহি॥
কাজল করি' যারে রাখি গো আঁখি-পাতে
স্বপনে যায় সে ধুয়ে গোপনে অশ্রু-সাথে।
বুকে তায় মালা করি' রাখিলে যায় সে চুরি
বাঁধিলে বলয়-সাথে মলয়ায় যায় সে উড়ি'
কি দিয়ে সে উদাসীন মন মোহি'॥
ভাবসন্ধান: প্রতিটি মানুষের মনোলোকের গভীরে বিরাজ করে তার চিরন্তন নায়ক বা নায়িকা। বাস্তবে যাকে মানুষ কখনো পায় না, কিন্তু তার জন্য চিরকালের হাহাকার রয়ে যায়- মানুষের সচেতন বা অবচেতন মনে। এই গানের নায়িকা কোনো সুনির্দিষ্ট নারী নয়, সামগ্রিক অর্থে আদর্শিক এবং চিরন্তন নারীসত্তা। তাই এই গানের নায়কও সেই নারীসত্তার আদর্শিক এবং চিরন্তন পুরুষ। তাকে কাছে পায় না বলেই এই চির্ন্তন নায়কের জন্য চিরন্তন নায়কার হাহকার। এই অসহনীয় অবর্ণনীয় বেদনা হাহাকার নিয়ত বয়ে যায় তাঁর সচেতন বা অবচেতন মনে। সে কথা কাউকে বলার নয়। না পাওয়ার ভয় তাঁকে সর্বদা বিকল করে রাখে। সে তার আপন মনের বেদনায় গন্ধবিধুর ধূপের মতে অবিরত পুড়ে যায়।
এই চিরন্তন নায়ক থাকে নায়িকার মনোলোকের নীলাকাশে, চন্দ্রের মতো। তাকে না পাওয়ার বেদনায় নায়িকা তার গোপন অশ্রু-সাগরে ভাসে। নায়িকা তাকে কাছে পায় না বলে সে ভাবে চিরন্তন এই নায়ক চন্দ্রের মতো বহুগামী। কিন্তু সে এতটাই হতভাগিনী যেন চন্দ্রগ্রাসী রাহুর মতো, ক্ষণিকের জন্যও পায় না। এখানে কবি নায়ককে কাছে না পাওয়ার চিরন্তন নারীসত্তার বেদনাকে উপস্থাপন করেছেন- সনাতন হিন্দুধর্মের পৌরাণিক কাহিনির দুটি চরিত্র 'চন্দ্র' ও 'রাহু'র রূপকতায়। দ্রষ্টব্য: পাদটীকা ১ ও ২]
চিরন্তন নারীসত্তার কাছে তাঁর চিরন্তন মানসপুরুষ চিরকাল অধরাই থেকে যায়। তার কাছে কখনো মনে হয়, সেই মানষপুরুষকে হয়তো কাছে রাখতে পেরেছে, পরক্ষণেই সে অনুভব করে, সে হারিয়ে গেছে। এই পাওয়া না পাওয়ার দ্বন্দ্বকে কয়েকটি রূপক নিদর্শন হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে এই গানে। নায়িকা তার মনোচোখের কাজল করে রাখতে পারে না, কারণ তারই স্বপ্নলোকের গোপন বেদনাশ্রুর সাথে সে হারিয়ে যায়। বুকের মালা করে রাখতে পারে না, কেউ তাকে চুরি করে নিয়ে যায়। হাতের বলয়ে বাঁধলে সে বাতাসে উড়ে যায়।
গানটির শেষে তার হাহাকার চিরন্তন অসহায়ত্বকে প্রকাশ করেছে। কারণ সে জানে না- কি দিয়ে সে তার প্রতি উদাসীন নায়ককের মনকে মোহিত করে, চিরকালের জন্য নিজের কাছে ধরে রাখবে।
পাদটীকা
- ১. চন্দ্র ছিলেন ব্রহ্মার মানসপুত্র অদ্রি'র পুত্র। দক্ষের ২৭টি কন্যাকে তিনি বিবাহ করেছিলেন। [সূত্র: ভাগবত পুরাণ, অষ্টম স্কন্ধ, অধ্যায় ১৩-১৪)]
- ২. রাহু হলেন পৌরাণিক দানব। মহাভারতের মতে- সমুদ্রমন্থনেরর সময় প্রথম চন্দ্রের উৎপত্তি হয়। এই কারণে একে বলা হয় অর্ণবোদ্ভব। সাগর থেকে উত্থিত হওয়ার পরে, চন্দ্র আকাশমার্গে গমন করেন এবং সেখান থেকে দেবতাদের পক্ষালম্বন করেন। দেবতাদের লুকানো অমৃত রাহু নামক এক দানব গোপনে পান করার সময় সূর্য ও চন্দ্র বিষ্ণুকে জানিয়ে দেন। বিষ্ণু তাঁর সুদর্শনচক্র দ্বারা রাহুর শরীর দুইভাগে বিভক্ত করে ফেলেন। এই কারণে রাহু চন্দ্রের শত্রুতে পরিণত হন। সুযোগ পেলেই রাহু চন্দ্রকে গ্রাস করেন। কিন্তু, শরীরের নিম্নাংশ কাটা বলে- ওই পথে চন্দ্র পুনারায় বের হয়ে আসেন। [সূত্র: মহাভারত। আদিপর্ব। অষ্টাদশ-ঊনবিংশ অধ্যায়]
- রচনাকাল ও স্থান: গানটির রচনার কোনো সুনির্দিষ্ট তারিখ পাওয়া যায় না। নওরোজ পত্রিকার 'শ্রাবণ ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ (জুলাই ১৯২৭) সংখ্যা'য় 'সারা ব্রিজ' নামক একটি নাটিকার প্রথম ও দ্বিতীয় দৃশ্য প্রকাশিত হয়েছিল। এই গানটি এই নাটকের সাথে প্রকাশিত হয়েছিল। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ২৮ বৎসর ২ মাস।
- পত্রিকা:
- রেকর্ড:
- ফোন-ও-ফোন। জুলাই ১৯৩১ (মাঘ -ফাল্গুন ১৩৩৭ বঙ্গাব্দ)। রেকর্ড টি ৬০৩৪। শিল্পী: কিরণময়ী দাসী
- এইচএমভি। ডিসেম্বর ১৯৩১ (অগ্রহায়ণ-পৌষ ১৩৩৮)। রেকর্ড পি ১১৭৩৫। শিল্পী কে মল্লিক[শ্রবণ নমুনা]
- স্বরলিপি ও স্বরলিপিকার:
- দিলীপ কুমার রায়। ভারতবর্ষ। শ্রাবণ ১৩৩৫ (জুলাই-আগষ্ট ১৯২৮)। [নমুনা]
- আহসান মুর্শেদ [নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপি, সাতাশ খণ্ড, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা। কার্তিক, ১৪১২/অক্টোবর ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দ] রেকর্ডে কাশেম মল্লিক-এর গাওয়া গানের সুরাবলম্বনে করা স্বরলিপি। দশম গান [নমুনা]
-
আহসান মুর্শেদ। [নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপি, তেপান্নতম খণ্ড, কবি নজরুল ইন্সটিটিউট, আশ্বিন ১৪২৮। সেপ্টেম্বর ২০২১] রেকর্ডে কিরণময়ী দাসী-র গাওয়া গানের সুরাবলম্বনে করা স্বরলিপি।গান সংখ্যা ৮। পৃষ্ঠা: ৩৭-৪১ [নমুনা]
- পর্যায়:
- বিষয়াঙ্গ: প্রেম। চিরন্তন প্রেমসত্তা
- সুরাঙ্গ: গজল
- রাগ: মিশ্র [বেহাগ- তিলক-কামোদ- খাম্বাজ]
- তাল: দাদরা
- গ্রহস্বর: সা