মৃত্যু-আহত দয়িতের তব শোনো করুণ মিনতি

মৃত্যু-আহত দয়িতের তব শোনো করুণ মিনতি।
অমৃতময়ী মৃত্যুঞ্জয়ী হে সাবিত্রী সতী॥
            ঘন অরণ্যে বাজে মোর স্বর
            মোরি রোদনে উঠিয়াছে ঝড়,
সাঁঝের চিতায় ঐ নিভে যায়, মম নয়নের জ্যোতি
                                    হে সাবিত্রী সতী!
যুগে যুগে তুমি বাঁচায়েছ মোরে মৃত্যুর হাত হতে
                                    দেবী সাবিত্রী সতী!
মোরি হাত ধ’রে রাজপুরী ছেড়ে চলেছ বনের পথে
                                        বিধবা অশ্রুমতী!
                জীবনের তৃষা মেটেনি আমার
                তুমি এসে মোরে বাঁচাও আবার,
মৃত্যু তোমারে করিবে প্রণাম, ধরার অরুন্ধতি
                                হে সাবিত্রী সতী॥

  • প্রেক্ষাপট ও ভাবসন্ধান:
    • প্রেক্ষাপট: গানটি ভারতবর্ষ পত্রিকার 'পৌষ ১৩৪৪' (ডিসেম্বর ১৯৩৭-জানুয়ারি ১৯৩৮) সংখ্যায় হিমাংশকুমার দত্তের স্বরলিপি-সহ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। প্রকাশিত গানের বাণী অংশের উপরে গানটির শিরোনাম উল্লেখ আছে 'অমৃতময়ী সাবিত্রী'। এই সূত্রে ধারণা করা হয়, গানটি হিন্দু পৌরাণিক আখ্যান 'সাবিত্রী-সত্যবান'-এর নায়িকা সাবিত্রী'র উদ্দেশ্যে গানটি রচনা করেছিলেন। এই সাবিত্রী যমের মুখোমুখী দাঁড়িয়ে কূটকৌশলে স্বামী সত্যবানের জীবন রক্ষা করেছিলেন। উল্লেখ্য, এই গানে সুরকার হিমাংশুকুমার দত্তের ছদ্মনাম ছিল 'সত্যবান'। তাই এই গানের পিছনে সুরকার সত্যবান এবং পৌরাণিক আখ্যানের সত্যবানের কোনো অজানা যোগসূত্র রয়েছে কিনা, এ নিয়ে সংশয় থাকলেও বিস্তারিত কিছু জানা যায় না।

      'সাবিত্রী-সত্যবান'-এর আখ্যানের সংক্ষিপ্ত বিবরণ: অশ্বপতি নামক রাজা সাবিত্রী দেবীকে (বেদমাতা গায়ত্রী) নিষ্ঠার সাথে পূজা করে একটি কন্যা লাভ করেন এবং এই কন্যার নাম রাখেন সাবিত্রী। অসাধারণ রূপবতী ও গুণবতী' এই কন্যার জন্য রাজা উপযুক্ত পাত্রের সন্ধানে ব্যর্থ হয়ে, সাবিত্রীকে নিজের পছন্দমতো স্বামী খুঁজে নেবার অনুমতি দেন। এরপর সাবিত্রী সদলবলে স্বামীর অনুসন্ধান করতে থাকেন এবং তিনি শাল্বদেশের রাজা দ্যুমৎসেনের পুত্র সত্যবানকে পছন্দ করেন। তাঁর পছন্দের কথা পিতা এবং নারদ মুনির সামনে উল্লেখ করলে,  নারদ সত্যবানের স্বল্পায়ুর কথা জানালেও সাবিত্রী এই বিবাহে অনড় থাকেন। বিবাহের এক বৎসর পরই সত্যবানের মৃত্যুর দিন উপস্থিত হয়। এই দিন সত্যবান বনে ফল ও কাঠ আনার জন্য উদ্যোগ নিলে , সাবিত্রী শ্বশুরের অনুমতি নিয়ে সত্যবানের সাথে বনে যান। ফল ও কাঠ সংগ্রহ করতে করতে সত্যবান হঠাৎ শিরঃপীড়া অনুভব করে অবসন্ন হয়ে পড়ে যান । পরে সাবিত্রী সত্যবানের মাথা কোলে তুলে নিয়ে মৃত্যুদূতের অপেক্ষা করতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর সাবিত্রী রক্তবস্ত্র পরিহিত বিরাটকায় এক ভয়ঙ্কর পুরুষকে সত্যবানের পাশে দেখতে পেলেন । সাবিত্রী জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন যে― তিনিই যম। সত্যবান পুণ্যবান এবং সাবিত্রী পতিব্রতা বলে, যমদূতের পরিবর্তে যম নিজেই এসেছেন। এরপর সত্যবানকে পাশবদ্ধ করে যমকে দক্ষিণ দিকে যেতে দেখে, সাবিত্রী যমের পিছু পিছু যেতে থাকেন। যম তাঁকে অনুসরণ না করে ফিরে যেতে বলেন। কিন্তু সাবিত্রী স্তব দ্বারা যমকে সন্তুষ্ট করলে , যম তাঁকে স্বামীর জীবন ছাড়া অন্য যে কোন বর প্রার্থনা করতে বলেন। সাবিত্রী যমের কাছ থেকে প্রথম বর প্রার্থনা করে তা পান, কিন্তু সাবিত্রী তারপরেও যমকে অনুসরণ করা থেকে বিরত হলেন না। যম সাবিত্রী কে থামানোর জন্য পাঁচবার বর দেন। চতুর্থ বর দানের পর, যম পঞ্চম বরে সত্যবানের প্রাণ ফিরিয়ে দিলেন, সাবিত্রী যমের অনুসরণ করা থেকে বিরত হন। যমের দেওয়া এই পাঁচটি বর ছিল―
       
    • প্রথম বর : তাঁর শ্বশুরের অন্ধত্ব দূর হওয়ার বর প্রার্থনা।
    • দ্বিতীয় বর : তাঁর শ্বশুরের রাজ্যলাভ প্রার্থনা।
    • তৃতীয় বর : সাবিত্রীর পিতার শতপুত্র লাভ প্রার্থনা ।
    • চতুর্থ বর : সত্যবানের ঔরসে সাবিত্রীর শতপুত্র  প্রার্থনা ।
    • পঞ্চম বর : সত্যবান জীবিত হওয়ার প্রার্থনা।
    উল্লেখ্য চতুর্থ বরে সাবিত্রীর শতপুত্র  লাভের প্রার্থনা মঞ্জুর হয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে সত্যবানের জীবন লাভের বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। পঞ্চম বর ছিল চতুর্থ বরের- প্রয়োগ মাত্র। এর ফলে যম সত্যবানকে মৃত্যুপাশ থেকে মুক্ত করে দেন এবং সাবিত্রী কে আশীর্বাদ করে বিদায় নেন।
     
    • ভাবসন্ধান:
      মৃত্যপথযাত্রী সত্যবানকে সাথে নিয়ে গভীর অরণ্যে সাবিত্রী চলেছেন। সত্যবান জানেন তাঁর মৃত্যু অনিবার্য। এই অকাল মৃত্যু থেকে একমাত্র সাবিত্রীই রক্ষা করতে পারেন। গানটির শুরুতেই উপস্থাপিত হয়েছে প্রাণরক্ষাকারিণী সাবিত্রীর কাছে দয়িত সত্যবানের বেঁচে থাকার প্রবল আকুতি-বাণী ।

      অন্তরাতে সত্যবানের বেঁচে থাকার আকুলতারই সম্প্রসারণ ঘটেছে। তিনি সাবিত্রীকে বলেন- তাঁর মৃত্যু-ভীত সকরুণ আবেদনেই যেন ঘন অরণ্যে উঠছে প্রবল ঝড়। তিনি সাবিত্রীকে স্মরণ করিয়ে দেন- জীবনের দিনশেষের সাঁঝের চিতায় তাঁর জীবনের সকল আশা-আকাঙ্ক্ষা, উপভোগের সকল বাসনা শেষ হয়ে যাবে।

      সঞ্চারীতে সত্যবান সাবিত্রীকে যুগযুগান্তরের শাশ্বত প্রাণদায়িনী দয়িতারূপে উপস্থাপন করেছেনে। এখানে সাবিত্রী হয়ে উঠেছেন- দেবী সাবিত্রী। সেই দেবীই দয়িতারূপা হয়ে তাঁর হাত ধরে চলেছেন। দয়িতের আসন্ন মৃত্যুর আশঙ্কায় বেদনা-কাতরা এই দেবী আজ অশ্রুমতী। 

      আভোগে উঠে এসেছে পুনরায় সত্যবানের বেঁচের থাকার প্রবল আকুতি। জীবনের কোনো তৃষ্ণাই তাঁর মেটেনি। সাবিত্রীর কাছে তাই তাঁর অকালমৃত্যু রোধের জন্য প্রার্থনা। কারণ সত্যবান জানেন, একমাত্র সাবিত্রীই পারেন তাঁর এই অকাল মৃত্যু রোধ করতে। পৌরাণিক ভিন্নতরে আখ্যানে রয়েছে, কিভাবে অগ্নির অবৈধ যৌন-কামনা থেকে নিজেকে রক্ষা করে বশিষ্ঠ মুনির সাথে স্ত্রী অরুন্ধতী পতিভক্তিতে অদ্বিতীয়া হয়ে ছিলেন। তাই মৃত্যুর পর অরুন্ধতী নক্ষত্ররূপে বশিষ্ঠের পাশে স্থান পেয়েছিলেন। পতিভক্তির একনিষ্ঠার বিচারে সত্যবান সাবিত্রীকে 'ধরার অরুন্ধতী' নামে আখ্যায়িত করেছেন। সত্যবান জানেন 'ধরার অরুন্ধতী' সাবিত্রীকে যম  উপেক্ষা করতে পারবেন না। যম ফিরে যাবেন সাবিত্রীকে প্রণাম করে। নবজীবনের আকাঙ্ক্ষা পূরণে সত্যবান বেঁচে উঠবেন অমৃতপ্রদায়িনী সাবিত্রীর করুণায়।
  • রচনাকাল ও স্থান: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। ভারতবর্ষ পত্রিকার 'পৌষ ১৩৪৪' (ডিসেম্বর ১৯৩৭-জানুয়ারি ১৯৩৮) সংখ্যায় গানটি হিমাংশকুমার দত্তের স্বরলিপি-সহ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। পত্রিকায় প্রকাশিত ওই স্বরলিপির শেষে উল্লেখ আছে- 'এ গানটি শ্রীযুত সত্যবান মহাশয় হিজ্‌ মাস্টার্স ভয়েস রেকর্ডে গাহিয়াছেন। [পৃষ্ঠা: ২৬-২৮]। এই তথ্যানুসারে অনুমান করা যায়, গানটি হিজ্‌ মাস্টার্স ভয়েস থেকে আগেই রেকর্ড করা হয়েছিল। কিন্তু রেকর্ডটি প্রকাশিত হয়েছিল পরে অর্থাৎ  'জুন (জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় ১৩৪৫) মাসে। গানটি পত্রিকায় প্রকাশের সময় নজরুল ইসলামের বয়স ছিল ৩৮ বৎসর ৭ মাস।
     
  • গ্রন্থ:
    • ‌‌‌‌‌‌‌‌‌নজরুল-সঙ্গীত সংগ্রহ [নজরুল ইনস্টিটিউট ফেব্রুয়ারি ২০১২। গান সংখ্যা ২০৮৪। পৃষ্ঠা: ৬২৮]
  • রেকর্ড:
    • এইচএমভি [জুন ১৯৩৮ (জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় ১৩৪৫)। এন ১৭০৮৪। শিল্পী: সত্যবান (হিমাংশু দত্ত)। সুর: হিমাংশু দত্ত।
  • পত্রিকা:
    • ভারতবর্ষ [পৌষ ১৩৪৪ (ডিসেম্বর ১৯৩৭-জানুয়ারি ১৯৩৮)। অমৃতময়ী সাবিত্রী। মিশ্র: রাগ। কথা: কাজী নজরুল ইসলাম। সুর ও স্বরলিপি: হিমাংশু দত্ত, সুরসাগর। স্বরলিপির শেষে উল্লেখ আছে- 'এ গানটি শ্রীযুত সত্যবান মহাশয় হিজ্‌ মাস্টার্স ভয়েস রেকর্ডে গাহিয়াছেন। পৃষ্ঠা: ২৬-২৮]
       
  • স্বরলিপি ও স্বরলিপিকার:
    • হিমাংশু দত্ত। ভারতবর্ষ।  পৌষ ১৩৪৪। ডিসেম্বর ১৯৩৭-জানুয়ারি ১৯৩৮। রেকর্ডে হিমাংশু দত্ত-এর গাওয়া গানের সুরানুসারে স্বরলিপি করা হয়েছে। [নমুনা]
      • সুরকার: হিমাংশু দত্ত।
    •  ইদ্‌রিস আলী। [নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপি, পঞ্চাশতম খণ্ড, কবি নজরুল ইন্সটিটিউট, কার্তিক ১৪২৬। জুন নভেম্বর ২০১৯। পঞ্চম গান। রেকর্ডে হিমাংশু দত্ত-এর গাওয়া গানের সুরানুসারে স্বরলিপি করা হয়েছে   [নমুনা]
      • সুরকার: হিমাংশু দত্ত।
  • পর্যায়: নাট্যগীতি (সকাতর মিনতি)
    • সুরাঙ্গ: রাগাশ্রয়ী
    • রাগ: মিশ্র
    • তাল: দাদরা
    • গ্রহস্বর:
      • ধ (হিমাংশু দত্ত)
      • ধা ইদ্‌রিস আলী।

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।