মেঘ-বিহীন খর-বৈশাখে। (megh-bihin khor-boishakhe)

মেঘ-বিহীন খর-বৈশাখে
তৃষায় কাতর চাতকী ডাকে॥
সমাধি-মগ্না উমা তপতী —
রৌদ্র যেন তার তেজঃ জ্যোতি,
ছায়া মাগে ভীতা ক্লান্তা কপোতী —
কপোত-পাখায় শুষ্ক শাখে॥
শীর্ণা তটিনী বালুচর জড়ায়ে
তীর্থে চলে যেনো শ্রান্ত পায়ে।
দগ্ধ-ধরণী যুক্ত-পাণি
চাহে আষাঢ়ের আশিস বাণী
যাপিয়া নির্জলা একাদশীর তিথি
পিপাসিত আকাশ যাচে কাহাকে॥]

 

  • ভাবার্থ: গানটি খরাপীড়িত বৈশাখের একটি বাণীচিত্র। এই চিত্রের শুরু হয়েছে মেঘবিহীন খর-বৈশাখে-  চাতকের মেঘবারি প্রত্যাশার কাতর প্রার্থনার মধ্য দিয়ে। প্রবাদ আছে মেঘের জল ছাড়া চাতক জলপান করে না। মূলত মেঘ বিহীন খর-বৈশাখের তীব্রতা উপলব্ধি করার জন্য কবি এখানে 'তৃষায় কাতর' চাতক-এর উপমা  উপস্থাপন করেছেন।

    অন্তরাতে খরা কবলিত বৈশাখের দাবদাহকে কবি উমা এবং তপতী নামক দুটি হিন্দু পৌরাণিক নারীর উল্লেখ করেছেন। একজন উমা (পার্বতী, দুর্গা), যিনি গভীর তপস্যা দ্বারা মহাদেবকে প্রার্থনা করেছিলেন। পার্বতীর তীব্র তপস্যা দেখে তাঁর মা মেনকা বলেছিলেন উঃ মা আর তপস্যা করিও না। এই কারণে দুর্গা বা পার্বতীর অপর নাম উমা। অন্যদিকে তপতী সূর্যকন্যা। যিনি তেজপূর্ণ রূপের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। কোনো কোনো অভিধানে তপতীকে সূর্যের পত্নী বলা হয়েছে। কিন্তু হিন্দু পৌরাণিক কাহিনিতে সূর্যের স্ত্রী হিসেবে পাওয়া যায় সংজ্ঞা এবং ছায়ার নাম। তাই এই গানে উমাই একমাত্র সমাধিমগ্না। অন্যদিকে  তপতী  সূর্যকন্যা বলেই তেজস্বিনী। 'রৌদ্র যেন তার তেজঃ জ্যোতি'র অর্থ দাঁড়া খর-বৈশাখের তীব্র তেজ-  সমাধিমগ্না উমা এবং তেজপূর্ণা তপতীর মতো।  পরপর্তী দুটি পংক্তিতে খর-বৈশাখের তেজের ভয়াবহ ব্যাপকতা বুঝানোর জন্য অসহায়া কপোতীকে উপস্থাপন করা হয়েছে। খর-বৈশাখের তীব্র দহনে কপোতী প্রাণভয়ে ভীতা। তাই সে আশ্রয় প্রার্থনা করছে কপোতের পাখার তলে বা বৃক্ষশাখার ছায়ায়।

    গানটির সঞ্চারীতে পাওয়া যায় খর-বৈশাখের প্রভাবে প্রাকৃতিক অবস্থার চিত্র। তীব্র দাবদাহে নদীর জল শুকিয়ে ক্ষীণ জলধারায় পরিণত হয়েছে। নদীর বুকে জেগে উঠা বালুচর যেন আষ্টে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে স্রোতস্বিনীকে। দীর্ঘ তীর্থযাত্রায় ভক্ত যেমন ক্লান্ত এবং মন্থর গতিতে এগিয়ে চলে, নদী-প্রবাহ যেন তেমন মন্থর। অন্তরাতে ফুটে উঠেছে এই দশা থেকে মুক্তি লাভের জন্য দগ্ধা পৃথিবীর করুণ প্রার্থনা। যেন দগ্ধা-ধরণী করজোড়ে আষাঢ়ের প্রবল-বর্ষণে মধ্য দিয়ে 'আশিস বাণী' প্রার্থনা করছে। খর-বৈশাখের এই দশাকে কবি নির্জলা একাদশী ব্রতের সাথে তুলনা করেছেন। সে ব্রতের সমাপন হোক- পিপাসিত আকাশের সাথে সমসাথী হয়ে কবিও এই প্রার্থনা করছেন এই গানে।

    এই গানটিতে রয়েছে খর-বৈশাখের এক নিটল চিত্ররূপ আর স্বরবিন্যাসে রয়েছে ধ্বনিচিত্র। তাই গানটির সুরের চলনে রয়েছে দগ্ধাপৃথিবীর কাতরতা। স্থায়ীর 'চাতকী ডাকে' অংশের 'মা রা মা। ধণাঃ -ধধঃ পা'- স্বরবিন্যাস সেই কাতরতাকে হৃদয়স্পর্শী অনুভবের সঞ্চার করে।

    অন্তরার সমাধীমগ্না উমা তপতীর পরে স্বরবিস্তার আছে। এই স্বরবিস্তার তানের চাঞ্চল্যের চেয়ে বেশি অনুভব জাগায় ধ্যানমগ্ন বিস্তারের গভীরতা। 'রৌদ্র যেন তার তেজ জ্যোতি তার' রৌদ্রের তীব্রতা তীব্রতর হয়ে উঠে তার সপ্তকের মধ্যমের আঘাতে। আর যখন সুরের আশ্রয়ে গানের বাণী ক্লান্তা কপোতীর কাছে ফিরে আসে, তখন স্বরবিন্যাস যেন ক্লান্তিতে আশ্রয় পাওয়ার জন্য উদারা ন্ পর্যন্ত নেমে আসে। কিন্তু কাতরতা প্রকাশের আকুতি প্রকাশিত হয়ে স্বরের আরোহণে এবং শেষ হয় ণধা র্সণা ধপা-র আকুতি দিয়ে। সঞ্চারীতে গানের সুর বয়ে চলে শীর্ণা নদীর মন্থর স্বরবিন্যাসে। এখানে 'রসা রা মপা গমা। মরা রসা সা' স্বরবিন্যাসে রয়েছে আষ্টে-পৃষ্টে জড়িয়ে ধরার স্বরানুভূতি। এই স্বরবিন্যাসে সৃষ্ট সুরশৈলী পাওয়া যায় আভোগেও।

    গানের বাণী যে চিত্ররূপ তৈরি করে, এর সুরবিন্যাস তেমনি ধ্বনিচিত্র তৈরি করে দেয়। আর সুর ও বাণীর সম্মিলনে গানটি হয়ে উঠেছে এক নান্দনিক চিত্রকল্প।

     
  • রচনাকাল ও স্থান: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ১ ডিসেম্বর (শুক্রবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৩৪৬) তারিখে 'বেতার জগৎ' পত্রিকায় গানটি প্রকাশিত হয়েছিল। সম্ভবত এই পত্রিকায় প্রকাশের কিছু আগে গানটি রচিত হয়েছিল। এই সময় নজরুল ইসলামের বয়স ছিল ৪০ বৎসর ৬ মাস।
     
  • গ্রন্থ:
    • নজরুল গীতি, অখণ্ড
      • প্রথম সংস্করণ [আব্দুল আজীজ আল-আমান সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। ৬ আশ্বিন ১৩৮৫। ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮
      • দ্বিতীয় সংস্করণ [আব্দুল আজীজ আল-আমান সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। ১ শ্রাবণ ১৩৮৮। ১৭ জুলাই ১৯৮১
      • তৃতীয় সংস্করণ [ব্রহ্মমোহন ঠাকুর সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। ৮ মাঘ ১৪১০। ২৩ জানুয়ারি ২০০৪। রাগ-প্রধান গান। ৯৩৫ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা ২৩৩-২৩৪]
      • পরিবর্ধিত সংস্করণ [আব্দুল আজীজ আল-আমান সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। বৈশাখ শ্রাবণ ১৪১৩। এপ্রিল-মে ২০০৬] ৯০২ সংখ্যাক গান। পৃষ্ঠা: ১৬৫।
    • নজরুল-সংগীত সংগ্রহ [রশিদুন্‌ নবী সম্পাদিত। কবি নজরুল ইন্সটিটিউট। তৃতীয় সংস্করণ দ্বিতীয় মুদ্রণ, আষাঢ় ১৪২৫। জুন ২০১৮। গান ২৪। পৃষ্ঠা ৮]
    • নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপি (প্রথম খণ্ড)। স্বরলিপিকার: সুধীন দাশ। প্রথম প্রকাশ, তৃতীয় মুদ্রণ [কবি নজরুল ইন্সটিটিউট। অগ্রহায়ণ ১৪০২। নভেম্বর ১৯৯৫। ২৪ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা ১১৫-১১৮]
    • বেণুকা প্রথম মূদ্রণ [নজরুল ইন্সটিটিউট। আষাঢ় ১৪১৩। জুন ২০০৬। ২৮ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা ৬৯-৭০]
  • বেতার:
    • হরপ্রিয়া গীতি আলেখ্য: (কাফি ঠাটের রাগ)। [৫ ডিসেম্বর  ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দ (মঙ্গলবার, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৩৪৬)। শিল্পী: গীতা মিত্র। রাগ: সাবন্ত সারং। সুর-নজরুল]
          [সূত্র: বেতার জগৎ। ১০ম বর্ষ ২৩ সংখ্যা। অনুষ্ঠান সূচী। পৃষ্ঠা: ৯১৭]
    • সারঙ্গ রঙ্গ (গীতি আলেখ্য. সারঙ্গ অঙ্গের রাগভিত্তিক অনুষ্ঠান)                
      • প্রথম প্রচার: কলকাতা বেতার কেন্দ্র। ৬ এপ্রিল ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দ (শনিবার ২৪ চৈত্র ১৩৪৬), সান্ধ্য অনুষ্ঠান। সন্ধ্যা ৭.১৫-৭.৫০ মিনিট। শিল্পী: শৈল দেবী [পাণ্ডুলিপি]
          [সূত্র: বেতার জগৎ-এর ১১শ বর্ষ, ৭ম সংখ্যা অনুষ্ঠান সূচী। পৃষ্ঠা: ৩৪০, ৩৬৯]
      • দ্বিতীয় প্রচার: কলকাতা বেতার কেন্দ্র। ২৩ নভেম্বর ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দ (শনিবার ৭ অগ্রহায়ণ ১৩৪৭)। তৃতীয় অধিবেশন। ৮.০০-৮.৩৯।
           [সূত্র:
        বেতার জগৎ। ১১শ বর্ষ ২২ সংখ্যা। পৃষ্ঠা: ১২৮৬
      • তৃতীয় প্রচার: ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দ (রবিবার, ৩ ফাল্গুন ১৩৪৮)। কলকাতা বেতার কেন্দ্র-১। তৃতীয় অধিবেশন। ৭.৪৫-৮.২৯।
            সূত্র:
         The Indian listener. Vol VII. No 3, page 79
  •  রেকর্ড: এইচএমভি [ [অক্টোবর ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দ (আশ্বিন-কার্তিক ১৩৫৪)। এন ২৭৭৪৮। শিল্পী ধীরেন্দ্রচন্দ্র মিত্র।] [শ্রবণ নমুনা]
  • সুরকার:
    • কাজী নজরুল ইসলাম। [বেতার জগৎ (পত্রিকা)]
    • ধীরেন্দ্র চন্দ্র মিত্র। [নজরুল-সঙ্গীত স্বরলিপি, প্রথম খণ্ড (কবি নজরুল ইন্সটিটিউট)। পৃষ্ঠা ১১৫]
  •  স্বরলিপিকার ও স্বরলিপি:সুধীন দাশ।  নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপি (প্রথম খণ্ড)। প্রথম প্রকাশ, তৃতীয় মুদ্রণ [কবি নজরুল ইন্সটিটিউট। অগ্রহায়ণ ১৪০২। নভেম্বর ১৯৯৫। ২৪ সংখ্যক গান] [নমুনা]
  •  পর্যায়:

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।