কোন্ মাটিতে আমার কায়া (kon matite amar kaya)

কোন্ মাটিতে আমার কায়া
           সৃজিলে হায় প্রভৃ মোর।
মস্‌জিদে মোর ঠাঁই নাহি পাই,
           সকল দেউল বন্ধ-দোর॥
ফিরি নগর-নারীর মতো
           কাফের দরবেশ বদ্-নসীব,
নাই বেহেশ্তের আশা আমার,
           দীন ও দুনিয়া শত্রু ঘোর॥
বেড়াই শ্রীহীন, দেয় অভিশাপ
           যে হেরে সেই আমারে,
রূপ-পূজারী ভুলতে নারি
           মোর প্রতিমার মুখ কিশোর॥  
চাইব শারাব, প্রিয়ার অধর
মরব যেদিন পানশালায়,
কোথায় নরক, কোথায় স্বরগ,
শারাব-নেশায় রইব ভোর॥

  • ভাবসন্ধান: সুফিবাদী দর্শনে রচিত এই গানে উপস্থাপিত হয়েছে- ধর্মীয় আচারানুষ্ঠানে বেড়াজাল-মুক্ত ভক্তের আত্মদর্শন। কিন্তু এই গানে মুক্ত-মানুষ হিসেবে আচারনিষ্ঠ হিন্দু ও মুসলমানের ধর্মান্ধতায় মূলে আঘাত হেনেছেন। 

     ইসলাম ধর্মমতে মানুষ সৃষ্টি হয়েছে মাটি থেকে। স্রষ্টার কাছে ভক্তের জিজ্ঞাসা, তাঁকে কি ভিন্নতর মাটিতে সৃষ্টি করেছেন তিনি। যে কারণে ধর্মাচারভ্রষ্ট বলে সকল মসজিদ ও মন্দিরে তাঁর প্রবেশাধিকার অবাঞ্ছিত হয়ে গেছে। তিনি নগর-নারীর (নারী যৌনকর্মী) যেমন ঘৃণিতা এবং আনন্দদায়িনী, তেমনি একই সাথে তিনি কাফেরের মতো ঘৃণিত এবং দরবেশর মতো মহান। তিনি এরূপ পরস্পর বিরোধী আচরণের জন্য, বেহেশ্‌তের আশা ত্যাগ করেছেন। কারণ ইহকাল ও পরকাল উভয় স্থানে তিনি নিজেকে পরিত্যক্ত মনে করেছেন। তাই তিনি শ্রীহীন হয়ে ঘুরে বেড়ান পথ পথে। তাঁর এই আচারবিহীন দশা দেখে তাঁর কৃতকর্মের জন্য অভিশাপ দেন।

    স্রষ্টা এবং তাঁর সৃষ্টির সত্য ও সুন্দরের পূজারী তিনি। তাঁর অন্তরের রূপ-প্রতিমার মাধুর্যর খুঁজে পান-   কিশোরের মতো নিষ্পাপ মুখচ্ছবিতে। তিনি ধর্মজ্ঞানরূপী জ্ঞানের শরাব পান করতে চান, আর চান ধর্মগুরুরূপী প্রিয়ার মুখনিসৃত স্রষ্টার প্রতি শাশ্বত প্রেম। প্রেম, তৃষ্ণা, আকাঙ্ক্ষার রসে ভরপুর গুরুমুখী বিদ্যাই  পরমাকাঙ্ক্ষিত কবির কাছে। যেদিন সর্বস্ব ত্যাগ করে মৃত্যুর মহিমায় এই পানশালায় ত্যাগ করবেন, সেদিনও তিনি বেহেশ্‌ত ও দোজখ চাইবেন না। তিনি সকল প্রলোভন ও শাস্তির ভয় ভুলে গিয়ে পরমস্রষ্টার ভাবদর্শনে ডুবে থাকবেন।

     
  • রচনাকাল ও স্থান: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। ১৩৩৭ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসে প্রকাশিত 'নজরুল গীতিকা' গ্রন্থে গানটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। এই  সময় নজরুলের বয়স ছিল ৩১ বৎসর ৩ মাস। ওমর খেয়ামের দুটি রুবাই- নিয়ে এই গানটি তৈরি করা হয়েছিল।
     
  • গ্রন্থ:
    • নজরুল-গীতিকা
      • প্রথম সংস্করণ [ভাদ্র ১৩৩৭ বঙ্গাব্দ। ২ সেপ্টেম্বর ১৯৩০। ওমর খৈয়াম-গীতি। ৭। কালাংড়া-আদ্ধাকাওয়ালী। পৃষ্ঠা ৭]
      • নজরুল রচনাবলী, জন্মশতবর্ষ সংস্করণ। তৃতীয় খণ্ড [বাংলা একাডেমী, ঢাকা ফাল্গুন ১৪১৩/মার্চ ২০০৭] নজরুল গীতিকা।  ওমর খৈয়াম-গীতি। ৭। কালাংড়া-আদ্ধাকাওয়ালী। পৃষ্ঠা: ১৭৪]
    • নজরুল-সঙ্গীত সংগ্রহ, (নজরুল ইনস্টিটিউট, মাঘ ১৪১৮। ফেব্রুয়ারি ২০১২)। ১৮১৭ সংখ্যক গান।
  • পর্যায়:
    • বিষয়াঙ্গ: ধর্মসঙ্গীত। ইসলাম। সুফিবাদী। ধর্মাচরণ

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।