শঙ্কর অঙ্গলীনা যোগ মায়া শঙ্করী শিবানী। (shonkar ongolina jog maya )
শঙ্কর অঙ্গলীনা যোগ মায়া শঙ্করী শিবানী।
বালিকা-সম লীলাময়ী নীল-উৎপল-পাণি॥
সজল-কাজল-ঝর্না
মুক্ত বেণী অপর্ণা,
তিমির বিভাবরী স্নিগ্ধা শ্যামা কালিকা ভবানী॥
প্রলয় ছন্দময়ী চণ্ডী শব্দ-নূপুর-চরণা,
শাম্ভবী শিব-সীমন্তিনী শঙ্করাভরণা।
অম্বিকা দুঃখহারিণী
শরণাগত-তারিণী,
জগদ্ধাত্রী শান্তিদাত্রী প্রসীদ মা ঈশানী॥
- ভাবসন্ধান: গানটি নজরুল রচিত 'নব রাগমালিকা' গীতিনাট্যের দ্বিতীয় অনুষ্ঠানের পঞ্চম গান। নজরুলের তৈরি শঙ্করী রাগে এই গানটি রচিত হয়েছিল। উল্লেখ্য এই রাগের নাম রাখা হয়েছিল হিন্দু পৌরাণিক দেবী শঙ্করী (দুর্গা)-এর নামানুসারে।
পৌরাণিক কাহিনিতে দুর্গা বিভিন্ন নামে অভিহিত হয়েছেন। নজরুল এসকল নাম এবং কিছু বিশেষণ পদের দ্বারা তাঁর নানা রূপের বর্ণা করেছেন। যেমন-- অঙ্গলীনা: দেবী শঙ্করের অঙ্গ তথা তাঁর সাথে একীভূত হয়ে অবস্থান করেন, তাই দুর্গাকে কবি শঙ্করের অঙ্গলীনা নামে অভিহিত করেছেন।
- অম্বিকা: অম্বা শব্দের অর্থ মাতা। জগৎ মাতা হিসেবে দুর্গাকে অম্বিকা বলা হয়।
- অপর্ণা: হিমালয় কন্যারূপী পার্বতী (দুর্গা) শিবকে স্বামী হিসাবে পাওয়ার জন্য কঠোর তপস্যা শুরু করেন। গ্রীষ্মের কঠোর উত্তাপ ও শীতকালের প্রচণ্ড শীতকে বরণ করে আত্মপীড়নের মধ্যে এই সাধনা অব্যাহত রাখেন। তপস্যাকালে তিনি খাদ্যগ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে দেন। একসময় তিনি শুধুমাত্র গাছের পাতা খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করতে থাকেন। তবুও পার্বতী মহাদেবকে স্বামী হিসাবে পেলেন না। এরপর তিনি গলিতপত্র পর্যন্ত গ্রহণ থেকে নিজেকে বিরত করলেন। এই কারণে তিনি অপর্ণা নামে পরিচিতি লাভ করেন।
- ঈশানী: ঈশ্ অর্থ প্রভূ। স্ত্রী লিঙ্গে ঈশানী হলো ঈশ্বরী।
- চণ্ডী: মার্কেণ্ডেয় পুরাণ মতে– মহিষাসুর বধের সময় তাঁর শরীর থেকে চণ্ডিকা নামক ভয়ঙ্কর ক্রোধী দেবীর আবির্ভাব ঘটেছিল। তাই তিনি চণ্ডী নামে অভিহিত হয়েছেন।
- জগদ্ধাত্রী: জগতের ধাত্রী অর্থে দুর্গার অপর নাম জগদ্ধাত্রী।
- ভবানী: দুর্গা বালিকার মতো লীলাময়ী। নীল পদ্মফুলের মতো তার হাত। সজল কাজলের ঝর্ণার মতো তিনি সদা বহমান। ভব সংসারের লীলাময়ী রূপে বিরাজ করেন, তাই তিনি ভবানী।
- যোগমায়া: মার্কেণ্ডেয় পুরাণ মতে– আদ্য শক্তি মহামায়া। মধু কৈটভের হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রজাপতি ব্রহ্মা ভগবান বিষ্ণুর যোগনিদ্রার স্তবস্তুতি করলে দেবী যোগমায়া মহাকালী রূপে প্রকাশিত হয়ে বিষ্ণুকে নিদ্রামুক্ত করেছিলেন। এরপর বিষ্ণু জলমগ্ন সাগর থেকে পৃথিবীকে উদ্ধার করেছিলেন। এই কারণে দুর্গার অপর নাম যোগমায়া।
- শঙ্করী: শঙ্করের (শিব) স্ত্রী এই অর্থে দুর্গার অপর নাম শঙ্করী। এছাড়া কল্যাণী অর্থেও দুর্গাকে এই নামে অভিহিত করা হয়।
- শিবাণী: শিবের স্ত্রী অর্থে শিবাণী।
- শাম্ভরী: শম্ভু (শিব)-এর সাথে সম্পর্কিত এই অর্থে শাম্ভবী। তবে শম্ভুর স্ত্রী হিসেবে অনেক সময় দুর্গাকে শাম্ভরী বলা হয়। এই অর্থে দুর্গাকে শিব-সীমন্তিনী, শঙ্করভরণা বলা হয়।
- শ্যামা:কালো রাত্রির মতো যে রূপ, তাকে বলা হয় শ্যাম। স্নিগ্ধ কালো রূপে প্রকাশিত রূপের জন্য তিনি কালী। আর শ্যামল বা সবুজ তৃণের মতো রূপময়ী, তাই তিনি শ্যামা।
- উল্লেখিত নাম ছাড়াও এই গানে দুরজগাকে দুঃখহারিণী, শরণাগত-তারিণী, শান্তিদাত্রী ইত্যাদি বিশেষণে অভিহিত করা হয়েছে।
- রচনাকাল ও স্থান: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ১১ মে (শনিবার ২৮ বৈশাখ ১৩৪৭), সন্ধ্যা ৭.০৫-টায় কলকাতা বেতারকেন্দ্র থেকে নজরুল-সৃষ্ট রাগ নিয়ে তৈরি 'নব রাগমালিকা' গীতিনাট্যের দ্বিতীয় পর্ব প্রচারিত হয়েছিল। এই গানটি ছিল এই পর্বের পঞ্চম গান। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ৪০ বৎসর ১১ মাস।
- গ্রন্থ:
- নজরুল-সঙ্গীত সংগ্রহ (নজরুল ইনস্টিটিউট, মাঘ ১৪১৮। ফেব্রুয়ারি ২০১২)। ১৭৪৬ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা: ৫১৯।
- নবরাগ
- নজরুল ইনস্টিটিউট। সেপ্টেম্বর ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দ)। ৯ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা: ২১-২২।[নমুনা]
- হরফ প্রকাশনী। কবির ৭৩তম জন্মদিন, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ)। ৯ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা: ২৭-২৮।
- বেতার: নবরাগ মালিকা। দ্বিতীয় পর্ব। কলকাতা বেতার কেন্দ্র। ১১ মে ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দ (শনিবার ২৮ বৈশাখ ১৩৪৭)। সান্ধ্য অনুষ্ঠান। ৭.০৫-৭.৪৪ মিনিট। পঞ্চম গান। শিল্পী: শৈল দেবী]
- সূত্র: বেতার জগৎ পত্রিকার ১১শ বর্ষ ৯ম সংখ্যার অনুষ্ঠান সূচী [পৃষ্ঠা: ৪৮৫]
- সূত্র: বেতার জগৎ পত্রিকার ১১শ বর্ষ ৯ম সংখ্যার অনুষ্ঠান সূচী [পৃষ্ঠা: ৪৮৫]
- সুরকার: কাজী নজরুল ইসলাম।
- স্বরলিপিকার: জগৎ ঘটক। [নবরাগ (নজরুল ইনস্টিটিউট। সেপ্টেম্বর ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দ)] [নমুনা]
- পর্যায়
- বিষয়াঙ্গ: নাট্যগীতি [ভক্তি, শাক্ত]
- সুরাঙ্গ: ধ্রুপদাঙ্গ
- রাগ: শঙ্করী (নজরুল-সৃষ্ট রাগ)।
- তাল: একতাল (চতুর্মাত্রিক)।
- গ্রহস্বর: শুদ্ধ গান্ধার।