গুণে গরিমায় আমাদের নারী আদর্শ দুনিয়ায় (gune gorimay amader nari adorsho duniyay)

গুণে গরিমায় আমাদের নারী আদর্শ দুনিয়ায়
রূপে লাবণ্যে মাধুরী ও শ্রীতে হুরী-পরী লাজ পায়॥
নর নহে, নারী ইসলাম, পরে প্রথম আনে ঈমান
আম্মা খাদিজা জগতে স‌র্বপ্রথম মুসলমান।
পুরুষের সব গৌরব ম্লান এক এই মহিমায়॥
নবী-নন্দিনী ফাতেমা মোদের সতী-নারীদের রানী
যাঁর ত্যাগ সেবা স্নেহ ছিল মরুভূমে কওসর পানি
যাঁর গুণ-গাথা ঘরে ঘরে প্রতি নর-নারী আজো গায়॥
রহিমার মত মহিমা কাহার তাঁর সম সতী কেবা
নারী নয় যেন মূর্তি ধরিয়া এসেছিল পতি-সেবা
মোদের খাওয়ালা জগতের আলা বীরত্বে গরিমায়॥
রাজ্য শাসনে রিজিয়ার নাম ইতিহাসে অক্ষয়
শৌর্যে সাহসে চাঁদ-সুলতানা বিশ্বের বিস্ময়
জেবুন্নেসার তুলনা কোথায়, জ্ঞানের তপস্যায়॥
আঁধার হেরেমে বন্দিনী হল সহসা আলোর মেয়ে
সেইদিন হতে ইসলাম গেল গ্লানির কালিতে ছেয়ে।
লক্ষ খালেদা আসিবে যদি এ নারীরা মুক্তি পায়॥

  • ভাবসন্ধান: তুরস্কের নারী আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী খালেদা এদিব হানুমের সম্বর্ধনার প্রেক্ষিতে  রচিত এই গানে, তাঁর গুণকীর্তনের সূত্রে, গুণে গরিমায় কতিপয় মুসলিম মহিয়সী নারীর অতুলনীয় মহিমাকে তুলে ধরা হয়েছে। এ গানে খালেদাকে উপস্থাপন করা হয়েছে- মুক্ত নারীর প্রতীক হিসেবে।

    কবি মনে করেন যে, গুণের বিচারে এই বিশ্বের বুকে মুসলিম নারীরাই আদর্শ। তাঁদের রূপ, লাবণ্য, মাধুর্য ও সৌন্দর্যের কাছে স্বর্গীয় হুরী ও পরীরাও লজ্জিতা হন। তাঁদের এই রূপে লাবণ্যে মাধুরী ও শ্রীর মহিমা শুধু বাহ্যিক নয়, আত্মিকও বটে। মূলত এই গানে বাহ্যিক রূপে চেয়ে আত্মিক রূপকেই উপস্থাপন করা হয়েছে সগৌরবে।

    প্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন নবির প্রথমা স্ত্রী, খাদিজা (রা.)। আধ্যাত্মিক দর্শনের বিচারে ইসলামের নব-আধ্যাত্মিক বাণী গ্রহণে এই নারী ছিলেন পুরুষদের চেয়ে অগ্রগামিনী। এই বিচারে তিনি সব পুরুষের  গৌরব ম্লান করে দেওয়ার মতো একটি অনন্য মহিমা রেখে গেছেন।

    সতীত্বের বিচারে কবি সমকালীন সকল নারীদের মধ্যে নবি-নন্দিনী ফাতেমাকে (রা.) সর্বশ্রেষ্ঠা হিসেবে সতী-নারীদের রানী হিসেবে অভিহিত করেছেন। তাঁর ত্যাগ, সেবা, স্নেহ ছিল যেন মরুভূমে কওসর পানির (বেহশ্‌তের পানি তুল্য)। তাই তাঁর গুণ-গাথা মুসলমানদের ঘরে ঘরে বন্দিত হয়।

    হযরত রহিমার(হযরত আইয়ুব (আঃ)-এর স্ত্রী) মতো মহৎ নারী আর কে আছেন, যিনি পতি-সেবার মূর্ত প্রতীক ছিলেন। হযরত আইয়ুব (আঃ) যখন রাজ্য হারিয়ে নিঃস্ব এবং কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী, তখন তাঁকে ছেড়ে সবাই চলে গিয়েছিল। একমাত্র তাঁর স্ত্রী রহিমা দীর্ঘ অসুস্থ স্বামীর সেবা করে গেছেন।

    খাওলা বিনত আল-আযওয়ার (বাঙালি উচ্চারণে 'খাওয়ালা')-এর মতো নারীরা ছিলেন বীরত্ব ও গরিমায় পৃথিবীর আলোস্বরূপ। এই গানে স্মরণ কবি করেছেন খায়ওলাকে (খাওলা বিনত আল-আযওয়ার, বাঙালি উচ্চারণে 'খাওয়ালা')। তিনি  বীরত্ব, জ্ঞান ও বিচক্ষণতার মাধ্যমে ইসলামের ইতিহাসে নারীশক্তির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। উল্লেখ্য, ৬৩৬ খ্রিষ্টাব্দে বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে সংঘটিত ইয়ারমুকের সিদ্ধান্তমূলক যুদ্ধ-সহ অন্যান্য বহু যুদ্ধে তিনি তাঁর ভাই দিরার বিন আল-আযওয়ারের (রাঃ) সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিলেন।

    এই গানে তিনি স্মরণ করেছেন- ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে প্রথম স্বাধীন মুসলিম নারী শাসিকা সুলতানা রাজিয়াকে। উল্লেখ্য সুলতান ইলতুৎমিশ তাঁর পুত্রদের তুলনায় কন্যা রাজিয়াকে বেশি যোগ্য মনে করতেন। তাঁর প্রিয় পুত্রের মৃত্যুর পর তিনি রাজিয়াকেই তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করে গিয়েছিলেন।

    কবি স্মরণ করেছেন- শৌর্য-সাহসে অতুলনীয়া দাক্ষিণাত্যের চাঁদ সুলতানাকে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে শৌর্য, সাহস এবং রাজনৈতিক বিচক্ষণতা দিয়ে এক অমর স্থান করে নিয়েছেন। এই কারণে কবি এই গানে বিশ্বের বিস্ময় হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সম্রাট আওরঙ্গজেবের বিদুষী কন্যা জেবুন্নেসাকে উল্লেখ করেছেন, জ্ঞান-তাপসিনী রূপে।

    কবি মনে করেন- মুসলিম সমাজের কুসংস্কার ও গোঁড়ামির কারণে যেদিন এই 'আলোর মেয়েরা' (জ্ঞান ও গুণবতী নারীরা) হঠাৎ করে অন্ধকার অন্তঃপুরে (হেরেমে) বন্দিনী হলেন। আর ঠিক সেই দিন থেকেই যেন ইসলামের গৌরব ও মর্যাদার জগৎ গ্লানি বা কলঙ্কের কালিমা দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে গেলো। কবি মনে করেন- যদি এই নারীরা বন্দীদশা থেকে মুক্তি পান এবং নিজেদের প্রতিভাকে প্রকাশ করতে পারেন, তবে লক্ষ লক্ষ নারী খালেদা (খালেদা এদিব হানুম) হয়ে ইসলামের সেবা ও গৌরব বৃদ্ধির জন্য এগিয়ে আসবেন।


     
  • রচনাকাল: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর (সোমবার ১৬ পৌষ ১৩৪১), তুরস্কের নারী আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী খালেদা এদিব হানুম কলকাতায় আসেন। তাঁর সম্বর্ধনায় কারমাইকেল হোস্টেলের ছাত্ররা এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে নজরুল 'গুণে গরিমায় আমাদের নারী‌' গানটি রচনা করেন। এই বিষয়ে আব্বাসউদ্দীন আহমদ তাঁর 'আমার শিল্পী জীবনের কথা' [প্রকাশক: মাশঘুদা বেগম, পৃথিবী, ২৪ পরগণা। পৃষ্ঠা ৯৭] গ্রন্থে লিখেছেন-

'কলকাতায় এসেছেন তুর্কী নারী-জাগরণের অগ্রদূতিকা খালিদা এদিব হানুম। তাঁকে অভ্যর্থনা করার জন্য কারমাইকেল হোস্টেলের ছেলেরা মেতে উঠেছে। কাজিদাকে গিয়ে ধরল ছেলেরা গান লিখে দিতে হবে। তিনি একখানা গান লিখে দিলেন। আমাকে বললেন সুর দিতে। তাঁর সে গানখানা সেদিন খালিদা হানুমের সভায় রেকর্ড করেছিই- "গুণে গরিমায় আমাদের নারী আদর্শ দুনিয়ায়...।"

এই সময় নজরুলে বয়স ছিল- ৩৫ বৎসর ৮ মাস।

  • গ্রন্থ:
    • নজরুল গীতি, অখণ্ড
      • প্রথম সংস্করণ [আব্দুল আজীজ আল-আমান সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। ৬ আশ্বিন ১৩৮৫। ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮]
      • দ্বিতীয় সংস্করণ [আব্দুল আজীজ আল-আমান সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। ১ শ্রাবণ ১৩৮৮। ১৭ জুলাই ১৯৮১]
      • তৃতীয় সংস্করণ [ব্রহ্মমোহন ঠাকুর সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। ৮ মাঘ ১৪১০। ২৩ জানুয়ারি ২০০৪। ইসলামী গান। ১০৬১ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা ২৬৮]
      • পরিবর্ধিত সংস্করণ [আব্দুল আজীজ আল-আমান সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। বৈশাখ শ্রাবণ ১৪১৩। এপ্রিল-মে ২০০৬] ভৈরবী-গজল। ১০৮৭ সংখ্যাক গান। পৃষ্ঠা: ২০৫-২০৬।
    • নজরুল-সংগীত সংগ্রহ [রশিদুন্‌ নবী সম্পাদিত। কবি নজরুল ইন্সটিটিউট। তৃতীয় সংস্করণ দ্বিতীয় মুদ্রণ, আষাঢ় ১৪২৫। জুন ২০১৮। গান ৩৭। পৃষ্ঠা ১২]
    • নজরুল-সঙ্গীত স্বরলিপি দ্বিতীয় খণ্ড। প্রথম প্রকাশ, দ্বিতীয় মুদ্রণ [কবি নজরুল ইন্সটিটিউট। পৌষ ১৪০২। ডিসেম্বর ১৯৯৫। ১২ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা ৬৯-৭৩]
    • সন্ধ্যামালতী (গান, শ্রাবণ ১৩৭৭। আগস্ট-সেপ্টেম্বর, ১৯৭১)। নজরুল-রচনাবলী─সপ্তম খণ্ড [নজরুল জন্মশতবর্ষ সংস্করণ। বাংলা একাডেমী, ১১ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪১৫। ২৫শে মে, ২০০৮। ১৩৫ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা ১৯৭]
    • নজরুল সঙ্গীত সম্ভার। বাংলা একাডেমী, ঢাকা। বৈশাখ ১৩৮৯/এপ্রিল ১৯৮২। পাণ্ডুলিপি-৭৯। ইসলামী ধর্ম্মসঙ্গীত।
  • রেকর্ড: টুইন [জানুয়ারি ১৯৩৫ (পৌষ-মাঘ ১৩৪১)। এফটি ৩৭৬৬। শিল্পী: আব্বাসউদ্দীন আহমেদ[[শ্রবণ নমুনা]
  • স্বরলিপি ও স্বরলিপিকার: সুধীন দাশনজরুল-সঙ্গীত স্বরলিপি, দ্বিতীয় খণ্ড। কবি নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা। ফাল্গুন ১৪১১। ফেব্রুয়ারি ২০০৫। ১২ সংখ্যক গান] [নমুনা]
  • পর্যায়:
    • বিষয়াঙ্গ: ধর্মসঙ্গীত। ইসলাম। মুসলিম নারী।
    • সুরাঙ্গ: রাগাশ্রয়ী।
    • রাগ: মিশ্র মালকোষ
    • তাল:  দাদরা
    • গ্রহস্বর: মা।

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।