শুকনো পাতার নূপুর পায়ে (shukno patar nupur paye)

শুকনো পাতার নূপুর পায়ে
                   নাচিছে ঘুর্ণিবায়
জল তরঙ্গে ঝিল্‌মিল্ ঝিল্‌মিল্
                   ঢেউ তুলে সে যায়॥
দীঘির বুকে শতদল দলি'
ঝরায়ে বকুল-চাঁপার কলি
চঞ্চল ঝরনার জল ছল ছলি
                   মাঠের পথে সে ধায়॥
বন-ফুল আভরণ খুলিয়া ফেলিয়া
আলুথালু এলোকেশ গগনে মেলিয়া
পাগলিনী নেচে যায় হেলিয়া দুলিয়া
                   ধূলি-ধূসর কায়॥
ইরানি বালিকা যেন মরু-চারিণী
পল্লীর-প্রান্তর-বনমনোহারিণী
আসে ধেয়ে সহসা গৈরিক বরণী
                   বালুকার উড়্‌নি গায়॥

  • ভাবার্থ: ফাল্গুন চৈত্র মাসে, গ্রাম বাংলার পথে-প্রান্তরে অনেক সময় এক ধরনের ঘূর্ণিবায়ু দেখা যায়। এই ঘূর্ণিবায়ু কোনো প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের সৃষ্টি করে না। ধুলিবালি, শুকনো পাতা ইত্যাদি ঘূর্ণিত করে এই বায়ু ছুটে চলে। তারপর এক সময় গতি হারিয়ে তা মিলিয়ে যায়। গ্রাম-বাংলার এই নিতান্ত সাধারণ ঘূর্ণি বায়ুকে কাজী নজরুল ইসলাম অসাধারণ রূপকল্প এবং উপমার ভিতর দিয়ে সুর ও ছন্দ দিয়ে উপস্থাপন করেছেন- একটি সচল চিত্রকল্পের ক্যানভাসে। যা চোখে দেখা যায়, তা মনোজগতের বাস্তব স্তর। শিল্প এই স্তরকে অতিক্রম যখন কল্প-বাস্তব জগতে প্রবেশ করে তখন তা হয়ে উঠে শিল্পীর সৃষ্টি। বাস্তবজগতকে দেখতে হয় চোখে খুলে, আর শিল্পের জগৎ দেখতে হয় বাইরে চোখকে বন্ধ করে। এই গানের রূপ মনোজগতের, যা একান্তই শিল্পের জগত, শিল্পীর জগৎ। তাই এই জগতের সাধারণ একটি ঘূর্ণি বায়ু হয়ে উঠেছে ছুটে চলা নৃত্যশীলা চঞ্চলা বালিকা। তার অবয়ব ধূলিময়, তাই তার বর্ণ গৈরিক। তার পায়ে পাতার নূপুর বাজে, তার গতিময় আবর্তনের ছন্দে।

    তার চলার পথের জলাশয়ের পদফুলের পাপড়ি, জলের ভিতরে প্রথিত হয়ে যায়। একে সাধারণভাবে বলা যায় বায়ুদলন। কবি তাই ঘূর্ণি-বালিকার নৃত্যাঘাতে পদফুলের অবস্থাকে 'শতদল দলি' ব্যবহার করেছেন। ঘূর্ণি-বালিকা থেমে থাকে না। সে শতদলকে দলিত করে এগিয়ে যায় বনভূমির পথে। সেখানে সে আন্দোলিত করে বনভূমির বকুল-চাঁপাকে। চঞ্চলা ঝর্নার বুকে ছলছল জলতরঙ্গধ্বনি মুখরিত করে, কিন্তু থেমে থাকে না। মুহুর্তেই সেই নৃত্যময়ী ঘূর্ণিবায়ু মাঠের পথে ধেয়ে যায়। চলতে চলতে তার চাপল্যে বনভূমির আভরণরূপী বনফুল খসিয়ে দেয়।

    কবির কল্পজগতের এই নৃত্যশীলা বালিকার ধূলিধূসরিত শরীরে ঊর্ধদিকের বিস্তার- হয়ে উঠেছে আলুথালু কেশ। আর তার এই অস্থির চলা যেন কোনো এক দিকভ্রান্ত পাগলিনীর সচঞ্চল গমন। ফাল্গুন-চৈত্র মাসের শুকনো প্রান্তর যখন মরুময় হয়ে উঠে, আর সেই প্রান্তরে ছুটে চলা ঘূর্ণিবায়ু হয়ে উঠেছে কবির কাছে মরুচারিণী ইরানি বালিকা। যেন হঠাৎ ছুটে আসা ধূলিধূসরিত গৈরিকবর্ণা নৃত্যশীলা বালিকা, যার অঙ্গের উড়নি বালুকাখচিত। ছুটে আসে প্রকৃতি তথা পল্লী, প্রান্তর, বনান্তের মনকে আপন সৌন্দর্যবিভায় মোহিত করে। আপনার নৃত্যান্দনে সে সবার মনকে হরণ করে নেয়।

    গানটিতে ব্যবহার করা হয়েছে আরবের মরুসুর। কিন্তু বাণী ও সুরের অপূর্ব মিশ্রণ, আরব-পারশ্যের প্রাকৃতিক পরিবেশকে অতিক্রম করে বাংলার হয়ে উঠেছে। গানের শুরুতে পাই বাংলার পদ্মফুল শোভিত জলাশয়, পাই বাংলার আরণ্যক ফুলের নাম। গানের শেষ অন্তরার ইরানি বালিকা শুধুই উপমা, সে পারশ্য-কন্যা হয়েও বঙ্গীয় জনপদের।

    ঘূর্ণিবায়ুর চাঞ্চল্যে এ গানের সুর বাঁধা, তাই এর প্রতিটি স্তবকের সুরের চলন পাল্টে যায়। স্থায়ীর শুরু থেকেই এর শুরু। চঞ্চল ঘূর্ণিবায়ুর ঘূরণন, স্থায়ীর 'ঘূর্ণি বায়'-এ স্পষ্ট হয়ে উঠে- 'জ্ঞ া মা া । ণা দা পা মা। জ্ঞা রা জ্ঞা মা'- সুরবিন্যাসে। এই চলনের ঘূর্ণিই সুরের অলঙ্কার হয়ে উঠেছে। একই ভাবে জলতরঙ্গের ঝিলিমিলি আন্দোলন নান্দনিক হয়ে উঠে ভিন্নরূপ স্বরবিন্যাসে। সুর-বাণীর এই মনকে ছুঁয়ে যায় 'ঢেউ' শব্দের মীড়সহযোগে 'রমা'। এখানে এসে শব্দের ঢেউ আর সুরের ঢেউ একাকার হয়ে যায়।

    গানটির প্রথম অন্তরায় সুরকার, দীঘির বুকে 'শতদল দলি'-তে কোমল ঋষভ ব্যবহার করেছেন। সুরের চঞ্চল চলনকে এই কোমল ঋষভ কিছুটা মন্থর করে দেয়। অন্যদিকে ঘূর্ণির বালিকা যে কোমল ঋষভে পা রেখে পদ্মফুলকে দলিত করে, তার চিত্ররূপ মূর্তমান হয়ে উঠে অন্যান্য স্বরসমূহকে সাথি করে। আবার এই কোমল ঋষভে ভর করেই ঘূর্ণিবালিকা বনভূমিতে পথে ধেয়ে যায়, সেখানে ঝরিয়ে দেয় বনের বকুল চাঁপাকে।

    দ্বিতীয় অন্তরায় আবার ঘূর্ণিবালিকা চঞ্চল হয়ে উঠে। সুরে বিন্যাসে অস্থির আলুথালু অবস্থাকে মূর্তমান করে তোলে। এই বিন্যাসে সুরের অস্থিরতা পাগলিনীর মতোই যেন দিকভ্রান্ত। শেষ অন্তারাতেও এই অস্থিরতা ইরানি বালিকার মনোহারিণী রূপকে স্পর্শ করেছে। এবং সেই রূপই সুরের ছোঁয়ায় ধ্বনিচিত্রের ব্যঞ্জনায় অপরূপ হয়ে উঠেছে।

     
  • রচনাকাল ও স্থান:  গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর (অগ্রহায়ণ-পৌষ ১৩৪০) মাসে, এই গানটির প্রথম রেকর্ড প্রকাশ করেছিল এইচএমভি রেকর্ড কোম্পানি। এই সময় নজরুলের বয়স  ছিল ৩৪ বৎসর৬ মাস।
  • গ্রন্থ:
    • গীতি-শতদল
      • প্রথম সংস্করণ [বৈশাখ ১৩৪১। এপ্রিল ১৯৩৪। আরবি সুর-কাহারবা।]।
      • নজরুল রচনাবলী, পঞ্চম খণ্ড [বাংলা একাডেমী। জ্যৈষ্ঠ ১৪১৮ মে, ২০১১ । গীতি-শতদল। গান সংখ্যা ১। আরবি সুর-কাহারবা (তাল)। পৃষ্ঠা ২৮৫]
    • নজরুল গীতি, অখণ্ড
      • প্রথম সংস্করণ [আব্দুল আজীজ আল-আমান সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। ৬ আশ্বিন ১৩৮৫। ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮]
      • দ্বিতীয় সংস্করণ [আব্দুল আজীজ আল-আমান সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। ১ শ্রাবণ ১৩৮৮। ১৭ জুলাই ১৯৮১]
      • তৃতীয় সংস্করণ [ব্রহ্মমোহন ঠাকুর সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। ৮ মাঘ ১৪১০। ২৩ জানুয়ারি ২০০৪। কাব্য-গীতি। ৭১২ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা ১৮৪]
      • পরিবর্ধিত সংস্করণ [আব্দুল আজীজ আল-আমান সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। বৈশাখ শ্রাবণ ১৪১৩। এপ্রিল-মে ২০০৬] ভৈরবী-গজল। ৭১০ সংখ্যাক গান। পৃষ্ঠা: ১৩৪।
         
    • নজরুল-সংগীত সংগ্রহ [রশিদুন্‌ নবী সম্পাদিত। কবি নজরুল ইন্সটিটিউট। তৃতীয় সংস্করণ দ্বিতীয় মুদ্রণ, আষাঢ় ১৪২৫। জুন ২০১৮। গান ৪৫। পৃষ্ঠা ১৫]
    • নজরুল-সঙ্গীত স্বরলিপি, দ্বিতীয় খণ্ড। স্বরলিপিকার: সুধীন দাশ।  প্রথম প্রকাশ, দ্বিতীয় মুদ্রণ [কবি নজরুল ইন্সটিটিউট। পৌষ ১৪০২। ডিসেম্বর ১৯৯৫। ১৯ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা ৯৫-৯৭]
    • সুরলিপিআগষ্ট ১৯৩৪ (শ্রাবণ ১৩৪১)। জগৎ ঘটক-কৃত স্বরলিপি গ্রন্থ। প্রকাশক: কাজী নজরুল ইসলাম
  • রেকর্ড: এইচএমভি [ডিসেম্বর ১৯৩৩ (অগ্রহায়ণ-পৌষ ১৩৪০)। এন ৭১৭৩। শিল্পী: মিস হরিমতী ]  [শ্রবণ নমুনা]
  • বেতার: জিপসীদের সঙ্গে (সঙ্গীতানুষ্ঠান)। কলকাতা বেতার কেন্দ্র। ২রা মার্চ ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের  (শনিবার, ১৮ ফাল্গুন ১৩৪৬)। সান্ধ্য অনুষ্ঠান: ৭.০৫-৭.৪৪ মিনিট
    • সূত্র: বেতার জগৎ। ১১ বর্ষ ৫ম সংখ্যার অনুষ্ঠান সূচী [পৃষ্ঠা ২৪৯]
       
  • স্বরলিপি ও স্বরলিপিকার:
  • সুরকার: কাজী নজরুল ইসলাম।
  • স্বরলিপি ও স্বরলিপিকার:
  • পর্যায়:
    • বিষয়াঙ্গ: প্রকৃতি
    • সুরাঙ্গ:
      • আরবি সুর। [নজরুল-সংগীত সংগ্রহ (রশিদুন্‌ নবী সম্পাদিত। কবি নজরুল ইন্সটিটিউট )। পৃষ্ঠা ১৫]
      • আরবী নৃত্যের সুর। [নজরুল গীতি, অখণ্ড (হরফ প্রকাশনী)। পৃষ্ঠা ১৮৪]
    • রাগ: মিশ্র।
    • তাল: কাহারবা [সঙ্গীত]
    • গ্রহস্বর: সা।

 

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।