স্বদেশ আমার জানি না তোমার (shodesh amar janina tomar)
স্বদেশ আমার! জানি না তোমার শুধিব মা কবে ঋণ।
দিনের পরে মা দিন চ’লে যায় এলো না সে শুভদিন॥
খাই দাই আর আরামে ঘুমাই
পাগলের যেন ব্যথা-বোধ নাই
ললাট-লিখন বলিয়া এড়াই ভীরুতা, শক্তি ক্ষীণ।
অভাগিনী তুমি, সন্তান তব সমান ভাগ্যহীন॥
কত শতাব্দী করেছি মা পাপ মানুষেরে করি ঘৃণা
জানি মা মুক্তি পাব না তাহার প্রায়শ্চিত্ত বিনা।
ক্ষুদ্র ম্লেচ্ছ কাঙাল ভাবিয়া
রেখেছি যাদেরে চরণে দাবিয়া
তাদের চরণ-ধূলি মাখি যদি আসিবে সে শুভদিন
নূতন আলোকে জাগিবে পুলকে জননী ব্যথা-মলিন॥
- ভাবসন্ধান: এটি একটি স্বদেশ পর্যায়ের উদ্দীপনা মূলক গান। হতভাগ্য দেশমাতা ও তাঁর সন্তানের হতাশা এবং সেই সাথে দুর্ভাগ্য, আত্মধিক্কার ইত্যাদি বিধৃত হয়েছে গানের সিংহভাগ জুড়ে। কিন্তু গানের শেষে রয়েছে সে দুর্দশা থেকে মুক্তির প্রত্যাশা। এই শেষ পংক্তিতে কবি সঞ্চার করেছেন দুর্ভাগ্য মোচনের আশা এবং উদ্দীপনা।
এই গানের শুরুতেই ফুটে উঠেছে স্বদেশ তথা মাতৃভূমির প্রতি, কবির অবহেলাজনিত অপরাধের জন্য অনুশোচনা। মাতৃভূমির সন্তান হিসেবে দেশমাতারা কাছে কবি নানাভাবে ঋণী সে কথা তিনি ভুলে যান নি। দিনের পর দিন চলে গেছে, কবি দেশমাতার দুর্দশা মোচনে সচেষ্ট হন নি, তাই দেশমাতার দুর্দশা মোচন হয় নি, কবিরও জীবনে শুভদিনের সূচনা হয় নি। স্থায়ীর দুটি পংক্তিতে ফুটে উঠেছে কবির গভীর অনুশোচনার ইঙ্গিত।
প্রথম অন্তরাতে, কবি তুলে ধরেছেন তাঁর আটপৌরে জীবনে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে আরাম আয়েসে দিন কাটানোর গ্লানির কথা। তিনি নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করে, ব্যক্ত করেছেন তাঁর স্বদেশের প্রতি অবহেলার কথা। পাগলের যেমন সুখ-দুঃখের বোধ থাকে না, তিনি যেন তেমনি বোধহীন দশার মধ্যে দিনপাত করেছেন। অন্যদিকে নিজের ভীরুতা, ক্ষীণশক্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে, দুর্ভাগ্যকে মেনে নিয়েছেন ভাগ্যের লিখন হিসেবে। ফলে অভাগিনী দেশমাতার মতো তিনি নিজেও অভাগা হিসেবে মেনে নিয়েছেন এবং দায়ী করেছেন দুর্ভাগ্যকে।
কবি মনে করেন, বহু শতাব্দী ধরে দেশমাতারা দুঃখমোচনে বিমুখ থেকে পাপ করেছেন, স্বদেশবাসীকে ঘৃণা করেছেন। যুগ যুগ ধরে জমে ওঠা এত পাপ ও ঘৃণা শুধু প্রায়শ্চিত্তের দ্বারা মোচন হবে কিনা, কবির মনে এই আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মধিক্কার প্রবলতর রূপে ফুটে উঠেছে।
কবির প্রত্যাশা, সমাজের নিচু স্তরের অস্পৃশ্য, কাঙাল বলে যাদের শাসন ও শোষণ করা হয়েছে, তাঁদেরই চরণস্পর্শে হয়তো একদিন শুভদিনের আবির্ভাব হবে। যে গভীর ব্যথায় দেশমাতা মলিন হয়ে আছে, সেখানে জাগবে সুখ-সমৃদ্ধির শুভ-আলোক। দেশমাতা জেগে উঠবে সৌন্দর্য-সৌরভে, পুলকে।
এই গানের শুরুতে রয়েছে চরম হতাশার কথা। আর শেষে পংক্তিতে শেষ পংক্তিতে কবি আমাদেরকে হতাশার অন্ধকার থেকে আশার আলোকে পৌঁছে দেওয়ার আশ্বাসবাণী উচ্চারণ করেছেন। এরই মধ্য দিয়ে গান হয়ে উঠেছে অমৃতময়। প্রায়শ্চিত্তের দ্বারা আত্মশুদ্ধ এবং সেখান থেকে সৌভাগ্যের আলোক তোড়ন উন্মোচনের অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে এই গান আমাদের প্রজ্জ্বলিত করেছে করে আশা এবং উদ্দীপনা আলোকপ্রদীপ।
- রচনাকাল ও স্থান: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। ' গুলবাগিচা' গীতি-সংকলনের প্রথম সংস্করণে [১৩ আষাঢ় ১৩৪০, ২৭ জুন ১৯৩৩] গানটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ৩৪ বৎসর ১ মাস
- গ্রন্থ:
- গুলবাগিচা
- প্রথম সংস্করণ [১৩ আষাঢ় ১৩৪০, ২৭ জুন ১৯৩৩। কেদার-একতালা। পৃষ্ঠা: ৭৮-৭৯]
- নজরুল রচনাবলী, জন্মশতবর্ষ সংকলন। পঞ্চম খণ্ড। বাংলা একাডেমী। ঢাকা। জ্যৈষ্ঠ ১৪১৮ মে, ২০১১। গুল-বাগিচা। গান সংখ্যা ৬৯। কেদার-একতালা। পৃষ্ঠা ২৬৬]
- নজরুল-সঙ্গীত সংগ্রহ [নজরুল ইনস্টিটিউট ফেব্রুয়ারি ২০১২। গান সংখ্যা ৯৫৪। রাগ: কেদারা, তাল: একতাল। পৃষ্ঠা: ২৯২।]
- গুলবাগিচা
- রেকর্ড: এইচএমভি [জুলাই ১৯৩৩ (আষাঢ়-শ্রাবণ ১৩৪০ বঙ্গাব্দ)। এফটি ৭১২৩। শিল্পী: কে. মল্লিক। [শ্রবণ নমুনা]
- অন্যান্য শিল্পী: মাসুদা আনাম কল্পনা (শ্রবণ নমুনা)
- স্বরলিপিকার ও স্বরলিপি:
- ড. রশিদুন্ নবী। নজরুল -সংগীত স্বরলিপি (৩৮তম খণ্ড)। নজরুল ইন্সটিটিউট। ঢাকা। জ্যৈষ্ঠ ১৪২৩ বঙ্গাব্দ/ জুন, ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে। গান সংখ্যা ২৪। পৃষ্ঠা: ৯৯- ১০২ [নমুনা]
- পর্যায়