চেয়ো না সুনয়না আর চেয়ো না এ নয়ন পানে (cheyo na shunoyona ar cheyo na e noyon pane)

চেয়ো না সুনয়না আর চেয়ো না এ নয়ন পানে।
জানিতে নাইকো বাকি, সই ও আঁখি কি যাদু জানে॥
একে ঐ চাউনি বাঁকা সুর্মা আঁকা তা'য় ডাগর আঁখি রে
বধিতে তা'য় কেন সাধ? যে মরেছে ঐ নয়ন বাণে।
                                  মরেছে ঐ আঁখির বাণে॥
চকোর কি প'ড়ল ধরা পীযূষ ভরা ঐ মুখ-চাঁদে (রে),
কাঁদিছে নার্গিসের ফুল লাল কপোলের কমল-বাগানে।
জ্বলিছে দিবস রাতি মোমের বাতি রূপের দেওয়ালি (রে),
নিশিদিন তাই কি জ্বলি' পড়ছ গলি' অঝোর নয়ানে।
মিছে তুই কথার কাঁটায় সুর বিঁধে হায় হার গাঁথিস কবি (রে)।
বিকিয়ে যায় রে মালা এই নিরালা আঁখির দোকানে॥

  • ভাবসন্ধান: কোন এক সুনয়নার প্রেমযাদু ভরা নয়ন-সৌন্দর্যে মোহিত কবি। তার যাদুকরী নয়নবাণ কবিকে এমন এক অনির্বচনীয় অসহনীয় প্রেমসৌন্দর্যে উদ্বেলিত করে তোলে যে, তিনি অসহায়ের মতো আত্মসমর্পণ করেন সুনয়নার কাছে। কারণ তিনি জানেন ওই নয়নবাণের যাদুতে রয়েছে প্রেমসৌন্দর্য-সাগরে মৃত্যুর মত নিজকে বিসর্জন দেওয়া।

    এই সুনয়নার সুরমা মাখা চোখে রয়েছে কটাক্ষবাণ, তার উপর তের ডাগর চোখ (বড় আয়াতাকার চোখ), ওই চোখ যেন প্রেমিককে প্রেমবাণে বিদ্ধ করতে উন্মুখ হয়ে রয়েছে। আর চোখের প্রেম বাণে বিদ্ধ হয়েছে যে, সেই জানে আঁখিবাণে মরণের মহিমা।

    এই সুনয়নার আঁখি বন্দনার পর, কবি তাঁর মুখমণ্ডলের সৌন্দর্যকে তুলে ধরেছেন রূপকল্পের অপরূপ মহিমায়। প্রথমে তিনি সুনয়না মুখমণ্ডলকে অমৃতভরা চন্দ্রমুখের সাথে তুলনা করেছেন। সে মুখের সৌন্দর্যের ছটা যেন- চন্দ্রের জ্যোছনার মতো। লোককথায় পাওয়া যায়- চকোর নামক পাখি নাকি  জোৎস্না পান করে তৃপ্ত হয়। কবি কল্পভাবনার বিহারে ভাবেন- ওই চন্দ্রমুখের জ্যোছনা পানের আশায় চকোররূপী কোনো প্রেমিক কি ধরা দিয়েছেন? কবির কি এটা শুধুই আত্মজিজ্ঞাসা, না কি ঈর্ষা, নাকি নিতান্তই সাধারণ কৌতুহল তা স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয় না। পরক্ষণেই কবি ভিন্ন রূপকল্পে সুনয়নার কপোলে দেখেছেন পদ্মবনের লালিমা মাখা অপরূপ সৌন্দর্য। সে রূপ দর্শনে লাল নার্গিস ফুল যেন নিজের রূপের ধিক্কারে কাঁদছে।

    এই সুন্দরীর সৌন্দর্য, প্রজ্জ্বলিত বাতির দেয়ালির মতো সৌন্দর্য-বিভায় উদ্ভাসিত। আলো ছড়িয়ে অভিমানী মোমবাতির মোম যেমন গলে পড়ে অশ্রু হয়ে, দেহ-মনের সৌন্দর্য-মহিমা যেন সুনয়নার অভিমানী নয়ন থেকে অশ্রু হয়ে অঝোরে ঝরে পড়ে।

    গজলাঙ্গের গানের ভণিতায় কবি উঠে এসেছেন তাঁর মুগ্ধতার মোহ ভেদ করে। সেখানে তিনি যেন তিনি নিতান্তই দর্শক, নিতান্তই কথক। মিছে কল্পভাবনায় কথা ও সুরের গাঁথা  সুনয়নার আঁখি-বন্দনা সবই কথক কবি ভাবেন বৃথা। তারপরেও নিজেকে নিজেই শোনান- এই আঁখি-বন্দনার দেওয়া-নেওয়ার আসরে- তিনি যেন এই মালা বিকিয়ে যেতে পারেন। তাই কবির কাছে সুনয়নার আঁখির চেয়ে পরম পাওয়া হয়ে ওঠে এই বাণী সুরের মালা গাঁথা।

     
  • রচনাকাল : গানটির রচনাকাল সম্পর্কে জানা যায় না। গানটি সওগাত পত্রিকার 'অগ্রহায়ণ ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ' সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। ধারণা করা হয়, গানটি তিনি ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসে রচনা করেছিলেন। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ২৮ বৎসর ৪ মাস।
     
  • পত্রিকা:
    • সওগাত। 'অগ্রহায়ণ ১৩৩৪' (নভেম্বর-ডিসেম্বর ১৯২৭)।
    • সঙ্গীত বিজ্ঞান প্রবেশিকা। কার্তিক ১৩৩৮। অক্টোবর-নভেম্বর ১৯৩১। কথা ও সুর: কাজী নজরুল ইসলাম। স্বরলিপি: শ্রীক্ষীরোদচন্দ্র রায় বি-এল্ [নমুনা]
  • গ্রন্থ:
    • বুলবুল
      • প্রথম সংস্করণ [নভেম্বর ১৯২৮। কার্তিক ১৩৩৫] গান ১২। বাগেশ্রী-পিলু-কাহারবা
      • নজরুল-রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড [বাংলা একাডেমী, ফাল্গুন ১৪১৩। ফেব্রুয়ারি ২০০৭। বুলবুল। গান ১২। বাগেশ্রী-পিলু-কাহারবা। পৃষ্ঠা: ১৬১]
  • রেকর্ড: এইচএমভি। ডিসেম্বর ১৯২৯ (অগ্রহায়ণ-পৌষ ১৩৩৬)। রেকর্ড নম্বর পি ১১৬৬১। শিল্পী
  • স্বরলিপি ও স্বরলিপিকার:
  • পর্যায়:
 

 

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।