হাসে আকাশে শুকতারা হাসে (hashe akashe shuktara )
হাসে আকাশে শুকতারা হাসে।
অরুণ-রঞ্জনী-উষার পাশে॥
ওকি উষসীর সাথি
বাসর ঘরে জাগে রাতি,
(ওকি) সখির মনের কথা জানে আভাসে॥
হাসির ছটায় ওর আঁখি কেন নাচে,
রবির রথের ধ্বনি ওকি শুনিয়াছে।
ও কেন দিবা আসিবার আগে
শ্রান্ত বধূর ঘুম ভাঙে,
(ওকি) ধরার সূর্যমুখী ফুটেছে নভে-
প্রিয়তমে প্রথম দেখার আশে॥
- ভাবসন্ধান: 'নব রাগমালিকা'র দ্বিতীয় পর্বের দ্বিতীয় গান। গানটি নজরুল-সৃষ্ট 'অরুণ রঞ্জনী' রাগে নিবদ্ধ। প্রত্যূষের সূর্য অরুণ। তাকে বর্ণ-বিভূষিত করে এই রাগ, তাই নজরুল এই রাগের নামকরণ করেছিলেন 'অরুণ রঞ্জনী'। রূপকতার মধ্য দিয়ে অরুণ রঞ্জনী রাগের ভাবগত 'লক্ষ্মণগীত' উপস্থাপিত হয়েছে এই গানে। তাই এই গানে অরুণ রঞ্জনী'র শাস্ত্রীয় বর্ণনা নেই। রয়েছে রাগ পরিবেশনের সময় এবং শৃঙ্গার রসের গভীর অনুভবের কথা।
এই গানের লক্ষ্য অরুণ রঞ্জনী'র রাগরূপকে উপস্থাপন করা, আর উপলক্ষ হলো ভোরের শুকতারার (ভোরের দেখা শুক্রগ্রহ) সৌন্দর্য বর্ণনা। স্থায়ীর দুটি পঙ্ক্তিতে রাগরূপের পরিবেশনের সময়কে তুলে ধরা হয়েছে। অতি-প্রত্যূষে দিবসের প্রথম সূর্যের উদয়ে প্রভাত যখন বর্ণ-বিভূষিত হয়ে ওঠে, তখন তার পাশে আকাশে শুকতারা হাস্যজ্জ্বল দ্যুতি ছড়ায়। এই সময়টাই অরুণ রঞ্জনীর পরিবেশনের সময়। 'অতি-প্রত্যূষ', সঙ্গীত শাস্ত্রমতে সময়টা দিবা প্রথম প্রহরের প্রারম্ভিক কাল।
অন্তরাতে কবি কাব্যরূপের রূপকতায়, অরুণ রঞ্জনীর রসধ্যায়ের অবতারণা করেছেন। এখানে শুকতারাকে উল্লেখ করেছেন ঊষসীর (প্রাক-সূর্যোদয় কাল) সাথি হিসেবে। ঊষসী যেন নবদম্পতির রঙ্গরসের সহচরী হয়ে সারারাত জেগে থাকে। কবি প্রশ্ন তোলেন- সে কি নবদম্পতির মনের কথা কোনো ভাবে জেনে গেছে? কবি মূলত শৃঙ্গারধর্মী ভাবের ভিতর দিয়ে এই রাগের প্রকৃতি হিসেবে শৃঙ্গার রসের কথাই ব্যক্ত করেছেন।
এর আভাষ পাওয়া যায় আভোগ ও সঞ্চারীতেও। কবি যেন ধরেই নিয়েছেন- 'শুকতারা' নবদম্পতির বাসর ঘরের মিলন রাত্রির কথা আভাসে জেনে গেছে, তাই সকৌতুক সে হাসে। রাত্রি শেষ হওয়ার আগে শ্রান্ত নববধূর ঘুম ভাঙে। যেমন ভূমিতে ফোটা সূর্যামুখী সূর্যকে দেখার প্রত্যাশ্যায় প্রস্ফুটিত হয়, তেমনি শুকতারা আকাশের সূর্যমুখীর মতো প্রিয়তমকে দেখার আশায় জেগে থাকে। এখানে শুকতারা এবং আর নববধূর প্রত্যাশা একাকার হয়ে যায়। এখানে কবি এই রাগের শৃঙ্গার রসকে এমন একটি গভীর অনুভবের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করতে চেয়েছেন, যেখানে রয়েছে বাসর ঘরের শ্রান্ত নববধূর সংগোপন সলজ্জ অনুভব। একই সাথে কবি এ্ই রাগের পরিবেশনের সময়কে আরও সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এই সময়টি প্রাক্-প্রত্যূষকে অতিক্রম করবে না। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে এই রাগের রসের অবসান হবে। অর্থাৎ রাগটি সূর্যোদয়ের পরে আর পরিবেশন করা যাবে না।
সুরাঙ্গের বিচারে এটি রাগাশ্রয়ী। ত্রিতালে নিবদ্ধ এই গানটির চলন খেয়ালাঙ্গের।
- রচনাকাল ও স্থান: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ১১ মে (শনিবার ২৮ বৈশাখ ১৩৪৭), সন্ধ্যা ৭.০৫টায় কলকাতা বেতারকেন্দ্র থেকে নজরুল-সৃষ্ট রাগ নিয়ে তৈরি 'নব রাগমালিকা' গীতিনাট্যের দ্বিতীয় পর্ব প্রচারিত হয়েছিল। এই গানটি ছিল এই পর্বের দ্বিতীয় গান। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ৪০ বৎসর ১১ মাস।
- গ্রন্থ:
- নজরুল-সঙ্গীত সংগ্রহ (নজরুল ইন্সটিটিউট, মাঘ, ১৪১৭/ফেব্রুয়ারি, ২০১৪) নামক গ্রন্থের ১৭৯৬ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা:৫৩৩।
- নবরাগ (নজরুল ইন্সটিটিউট, সেপ্টেম্বর, ২০০৫) নামক গ্রন্থের ৪ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা: ৯-১০।[ নমুনা]
- সন্ধ্যামালতী
- প্রথম সংস্করণ [শ্রাবণ ১৩৭৭ (জুলাই-আগষ্ট ১৯৭১)]
- নজরুল রচনাবলী জন্মশতবার্ষিকী সপ্তম খণ্ড [১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৫, ২৫ মে ২০০৮। সন্ধ্যামালতী, গান ৫৪। পৃষ্ঠা: ১৫২]
- বেতার:
- নবরাগ মালিকা। দ্বিতীয় পর্ব। ১১ মে ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দ (শনিবার ২৮ বৈশাখ ১৩৪৭)। সন্ধ্যা ৭.০৫টা। চতুর্থ গান। শিল্পী: গীতা মিত্র] [মাসুদা আনাম (শ্রবণ নমুনা)]
- সুরকার: কাজী নজরুল ইসলাম।
- স্বরলিপিকার:
- জগৎ ঘটক। নবরাগ, নজরুল-সংগীত স্বরলিপি (নজরুল ইন্সটিটিউট,সেপ্টেম্বর,২০০৫)
- বিষয়াঙ্গ: প্রকৃতি ও সঙ্গীত
- সুরাঙ্গ: খেয়ালাঙ্গ।
- রাগ: অরুণ-রঞ্জনী (নজরুল-সৃষ্ট রাগ)।
- তাল: ত্রিতাল।
- গ্রহস্বর: সা।