জাগো নারী জাগো বহ্নি-শিখা (jago nari jago bohni-shikha)
জাগো নারী জাগো বহ্নি-শিখা।
জাগো স্বাহা সীমন্তে রক্ত-টিকা॥
দিকে দিকে মেলি' তব লেলিহান রসনা,
নেচে চল উন্মাদিনী দিগ্বসনা,
জাগো হতভাগিনী ধর্ষিতা নাগিনী,
বিশ্ব-দাহন তেজে জাগো দাহিকা॥
ধূ ধূ জ্ব'লে ওঠ ধূমায়িত অগ্নি,
জাগো মাতা, কন্যা, বধূ, জায়া, ভগ্নী!
পতিতোদ্ধারিণী স্বর্গ-স্খলিতা
জাহ্নবী সম বেগে জাগো পদ-দলিতা,
মেঘে আনো বালা বজ্রের জ্বালা
চির-বিজয়িনী জাগো জয়ন্তিকা॥
- ভাবসন্ধান: পুরুষ শাসিত সমাজে যুগ যুগ ধরে নিষ্পেষিতা নারী তার দাসত্বের শৃঙখল ভেঙে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক, সর্বার্থে ঘটুক শাশ্বত নারী জাগরণ- এই গান তারই দীপ্ত চেতনায় রচিত হয়েছিল।
গানটি আলেয়া নাটকে ব্যবহার করা হয়েছিল জয়ন্তী'র অভিব্যক্তি হিসেবে। এই নারী তেজে ও শক্তিতে রানি। নারীর তেজদীপ্ততাই তার শক্তি। তাঁর সাথী যোগিনীরা নারীশক্তিকে জাগরিত করার জন্য গানটি উপস্থাপন করেছেন।
নারী তার সুপ্ত শক্তিকে জাগরিত করে অগ্নিশখার মতো প্রকাশিত হোক কবির এমনটাই প্রার্থনা। রক্ত-টিকা সিঁথিতে ধারণ করে নারী জেগে উঠুক অগ্নি দেবতার স্ত্রী স্বাহার মতো। উল্লেখ্য হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে স্বাহা ছিলেন স্বাধীনচেতা দেবী। তিনি তাঁর ইচ্ছাকে পুরণে আপষহীন ছিলেন। [দ্রষ্টব্য: টিকা-১]
নারী জেগে উঠুক তার শক্তির লেলিহান কামনায়। নারী দিগ্বসনা কালীর মতো সর্বব্যাপ্ত মহিমায় নাচুক অপশক্তি বিনাসিনী হয়ে। [দ্রষ্টব্য: টিকা-২]
ধর্ষিতা, নিষ্পিষতা হতভাগিনীদের সকল অপমান বিসর্জন দিয়ে, কবি নারীকে বিশ্ব-দাহন তেজে দাহিকা শক্তি রূপে জেগে উঠার আহবান করেছেন এই গানে। চারিদিক শুভশক্তি বিনাসীদের অত্যাচরের অশুভ আগুন অবিরাম জ্বলছে। সেই অশুভ শক্তির প্রতিরোধে কবি জেগে ওঠার আহ্বান করেছেন মাতা, কন্যা, বধূ, জায়া, ভগ্নীকে। পতিত বা পাপীকে উদ্ধার করার জন্য স্বর্গের গঙ্গা মরত্যে নেমে এসেছিলেন। তেমনি নারী-শক্তি জাহ্নবীর (গঙ্গা দেবীর অপর নাম) মতো নেমে আসুক পাপীদের পদদলিত করে উদ্ধারের জন্য। স্নিগ্ধ মেঘে ছড়িয়ে পড়ুক বিদ্রোহিনীদের বজ্র-বিদ্যুতের জ্বালা। নারী হয়ে উঠুক চিরবিজয়িনী, জেগে উঠুক বিজয়-পতাকা-রূপিণী 'জয়ন্তিকা'।
টিকা: ১: দেবতাদের কাছে ব্রাহ্মণদের হবি পৌঁছানোর জন্য যখন প্রকৃতি দেবীকে দাহিকা শক্তি হতে বলা হয়, তখন তিনি তা অস্বীকার করেন এবং বিষ্ণুর স্মরণাপন্ন হন। বিষ্ণু দ্বাপর যুগে তাঁকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করবেন- এই অঙ্গীকারের সূত্রে প্রকৃতি দেবী অগ্নির দাহিকা শক্তি হিসেবে স্বাহা রূপে দেবতাদের কাছে ব্রাহ্মণদের হবি পৌঁছানোর কাজে রাজি হন।
সপ্তর্ষিদের স্ত্রীদের প্রতি অনুরক্ত অগ্নিকে স্বামী হিসেবে পাওয়ার জন্য তিনি অসাধ্য সাধন করেছিলেন। তিনি কৌশলে সপ্তর্ষিদের রূপ ধরে (অরুন্ধতী ছাড়া) অগ্নির সাথে মিলিত হন এবং কার্তিকেয় নামক পুত্র লাভ করেন।
- টিকা: ২। আদ্য শক্তি কালী (দুর্গা) বিশ্বময়ী। তাঁকে আবৃত করা মতো কোনো বসন নেই। তাই তিনি দিগ্বসনা বা নগ্নিকা। রাজা সগরের অশ্বমেধ যজ্ঞের অশ্ব উদ্ধার করতে গিয়ে, তাঁর ষাট হাজার পুত্র কপিল মুনির রোষে ভষ্মীভূত হলে, সগরের পৌত্র অংশুমান এই অশ্বকে উদ্ধার করেন এবং ভষ্মীভূত সগর-পুত্রদের উদ্ধারের উপায় জেনে আসেন। । ভগীরথ গঙ্গাকে স্বর্গ থেকে এনে এই কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন।
টিকা: ৩। অযোধ্যার উপায়টি হলো- যদি স্বর্গের গঙ্গানদীকে পৃথিবীতে এনে- এই ভষ্মের উপর দিয়ে প্রবাহিত করা যায় তবে এই পুত্ররা জীবিত হয়ে উঠবেন।
- রচনাকাল ও স্থান: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। এই গানটি 'আলেয়া' গীতিনাট্যে ব্যবহৃত হয়েছিল। উল্লেখ্য, কল্লোল পত্রিকার 'আষাঢ় ১৩৩৬' সংখ্যার 'সাহিত্য-সংবাদ' বিভাগে' বিষয়ে একটি তথ্য পাওয়া যায়। তথ্যটি হলো-
'নজরুল ইসলাম একখানি অপেরা লিখেছেন। প্রথমে তার নাম দিয়েছিলেন 'মরুতৃষ্ণা'। সম্প্রতি তার নাম বদলে 'আলেয়া' নামকরণ হয়েছে। গীতি-নাট্যখানি সম্ভবত মনমোহনে অভিনীত হবে। এতে গান আছে ত্রিশখানি। নাচে গানে অপরূপ হয়েই আশা করি এ অপেরাখানি জনসাধারণের মন হরণ করবে।'
এই বিচারে ধারণা করা যায়, গানটি নজরুল রচনা করেছিলেন, ১৩৩৬ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় (জুন-জুলাই ১৯২৯) মাসের দিকে। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ৩০ বৎসর ১ মাস।
- মঞ্চস্থ নাটক: আলেয়া। ' নাট্যনিকেতন' রঙ্গমঞ্চ। ৩রা পৌষ ১৩৩৮ (শনিবার ১৯ ডিসেম্বর ১৯৩১)। দ্বিতীয় অঙ্ক: যোগিনীদের গান।
- গ্রন্থ:
- আলেয়া
- প্রথম সংস্করণ [ডি,এম, লাইব্রেরী। ১৩৩৮ বঙ্গাব্দ। দ্বিতীয় অঙ্ক: যোগিনীদের গান]
- নজরুল রচনাবলী, জন্মশতবর্ষ সংস্করণ। চতুর্থ খণ্ড [বাংলা একাডেমী, ঢাকা জ্যৈষ্ঠ ১৪১৮। মে ২০১১। আলেয়া। দ্বিতীয় অঙ্ক: যোগিনীর গান। পৃষ্ঠা: ৩৪৪-৩৪৫]
- নজরুল গীতিকা।
- প্রথম সংস্করণ [ভাদ্র ১৩৩৭ বঙ্গাব্দ। ২ সেপ্টেম্বর ১৯৩০। জাতীয় সঙ্গীত। ১৩। সারং-কাওয়ালি। পৃষ্ঠা ৪২]
- নজরুল রচনাবলী, জন্মশতবর্ষ সংস্করণ। তৃতীয় খণ্ড [বাংলা একাডেমী, ঢাকা জ্যৈষ্ঠ ১৪১৮। মে ২০১১। সারং-কাওয়ালি। পৃষ্ঠা: ১৯৩-১৯৪]
- আলেয়া
- পত্রিকা:
- জয়তী [বৈশাখ ১৩৩৭। এপ্রিল-মে ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দ)]
- ধূমকেতু [ডিসেম্বর ১৯৩১ (পৌষ ১৩৪১)]
- রেকর্ড:
- মেগাফোন [আগষ্ট ১৯৩৬ (শ্রাবণ-ভাদ্র ১৩৪৩)। শিল্পী: জ্ঞান দত্ত। জে.এন.জি. ৩৩৮]
- এইচএমভি [জুলাই ১৯৪৯ (আষাঢ়-শ্রাবণ ১৩৫৬) । শিল্পী: জগন্ময় মিত্র। এন ৩১০৪৯] [শ্রবন নমুনা]
- স্বরলিপিকার ও স্বরলিপি:
- রশিদুন্ নবী । নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপি (দশম খণ্ড)। প্রথম প্রকাশ, ৩ ফাল্গুন, ১৩৯৯ বঙ্গাব্দ/ ২৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দ। নবম গান] [নমুনা]
- ইদ্রিস আলী। ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের আগষ্ট মাসে মেগাফোন রেকর্ড কোম্পানি থেকে প্রকাশিত গানের [শিল্পী: জ্ঞান দত্ত] সুরানুসারে স্বরলিপিটি নজরুল-সঙ্গীত স্বরলিপি আটচল্লিশতম খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। [নমুনা]
- পর্যায়