শংকর-রূপে শ্যামল আওল
শংকর-রূপে শ্যামল আওল।
ত্রিনয়ন মেলি’ আঁখি-প্রসাদ বিলাওল॥
দাঁড়াল ত্রিভঙ্গে
নীপবন রঙ্গে
পঞ্চশর সঙ্গে করি’ সঙ্গীত গাওল॥
গোপিনীরা ভাবে, গাহে বিহঙ্গ বুঝি
স্বপ্নাবেশে রাতে ফেরে শ্যামে খুঁজি।
হেরি পিনাক পাণি
মুখে ঘোম্টা দিল টানি –
দিগ্ বসনে হেরিয়া রাজে রাধা লুকাওল॥
- ভাবসন্ধান: গানটি বিলাবল ঠাটের শঙ্করা রাগের লক্ষণগীত। এই গানটির বাণী দ্ব্যর্থক। এর একটি অর্থে পাওয়া যায়, হিন্দু পৌরাণিক কাহিনির ছায়া। অপর অর্থে রয়েছে শঙ্করা রাগের লক্ষণ।
পৌরাণিক ভাবার্থে পাওয়া যায় শঙ্কর অর্থাৎ শিবের ছদ্মবেশে শ্যাম তথা কৃষ্ণের উপস্থিত। কৃষ্ণের এই রূপ থেকে বৃন্দাবনের গোপিনীরা বিভ্রান্ত। তাই শিবরূপী কৃষ্ণকে দেখে রাধা এবং এবং তাঁর সখিরা নিজেদেরকে রাসলীলা থেকে নিবৃত্ত করেন এবং আত্মগোপন করেন।
এই গানের রাগ লক্ষণে কবি প্রথমেই কবি- কৌশলে রাগনাম উল্লেখ করেছেন 'শঙ্করা'। শৃঙ্গাররূপী স্নিগ্ধ রূপ ত্যাগ করে শঙ্করা রাগের আবির্ভাব হয়। এই রাগের রূপ শুদ্ধ স্বরে নিবদ্ধ বিলাবল ঠাটের এবং স্নিগ্ধ রূপ বর্জিত। শঙ্করের ত্রিনয়নের প্রখরতা ছড়িয়ে পড়ে। তাই তার আবিরভাব বিলাওল (বিলাবল) ঠাটে। শঙ্করার এই রূপ বর্ণনার পরক্ষণেই কবি- শ্যামের স্নিগ্ধরূপের কাছে ফিরে গেছেন।
এর নাম রুদ্র শিব বা শঙ্করা হলেও এর প্রকৃত রূপ অত্যন্ত শ্যামের নৃ্ত্যের ত্রিভঙ্গ রূপের মতোই মনোহর। সঙ্গীতের শাস্ত্রের ত্রিভঙ্গ শব্দের অর্থ করা যেতে পারে বক্র। অর্থাৎ শঙ্করা চলন সরল নয়। আর এই রূপ নীপ (নি পা) -এর ব্যবহারে এর আনন্দময় রঙ্গময় হয়ে ওঠে।
এর আরোহের চলনে থাকে পাঁচটি স্বর যা মদনদেবের পঞ্চশরের ন্যায় প্রেম-সঞ্চারী। এই পাঁচটি স্বর হলো- স গ প ন ধ। গোপিনীরা অর্থাৎ গা পা ন র-এর প্রয়োগে মনে হয় যেন রাগ বিহাগ পরিবেশিত হচ্ছে। স্বপ্নাবেশে অর্থাৎ স প ন -এর প্রয়োগে গভীর রাতের বিহাগের বিরহ-বেদনা স্বপ্নমোহ তৈরি করে। বেহাগের আবেশে মধ্যমের সন্ধান করে, ব্যর্থ হতে হয়, কারণ শঙ্করাতে মধ্যম নেই।
এখানে কবি কৌশলে এই রাগ পরিবেশনের সময় হিসেবে জানিয়ে দেন- 'রাত্রিকাল'। উল্লেখ্য শাস্ত্রমতে এই রাগের পরিবেশনকাল রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর। পাণি পা নি ব্যবহারের শঙ্করা রাগ একটি স্বতন্ত্ররূপে প্রকাশ পায়। এই রাগে রাধা (ঋষভ এবং ধৈবত)-খুবই দুর্বলভাবে ব্যবহার করা হয়া।
দেবতা শঙ্করের ধনুকের নাম পিণাক। পিণাক পাণি হলো- শঙ্করের রুদ্ররূপের একটি। শঙ্করা রাগে প ণ অবরোহে মীড়-সহযোগে ব্যবহৃত হয়। যেন শঙ্করের ধনুকের মতো সে রূপ। এর মধ্য দিয়ে শঙ্করের নগ্ন রূপ প্রকাশ পায়, অর্থাৎ বেহাগের আবেশ থেকে শঙ্করা স্বমহিমায় আত্মপ্রকাশ করে। এই সময় র ধ স্বর দুটি বর্জিত দশায় থাকে। উল্লেখ্য শঙ্করার আরোহণে ঋষভ বর্জিত, তাই রা ধা-এর একত্রে ব্যবহার নেই। অবরোহণে ধা এবং রা দুর্বল। অবরোহণে এর রূপ পাওয়া যায়, ন ধ র্স ন, প, গ প, গ, র স।
- রচনাকাল ও স্থান: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের [২৮ ডিসেম্বর ১৯৩৯ (বৃহস্পতিবার ১২ পৌষ ১৩৪৬) কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে নজরুলের রচিত ঠাট-ভিত্তিক 'মেল-মেলন' নামক গীতি-আল্লেখ্য প্রচারিত হয়। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ৪০ বৎসর ৭ মাস।
- গ্রন্থ:
- নজরুল-সঙ্গীত সংগ্রহ (নজরুল ইন্সটিটিউট, মাঘ, ১৪১৭/ফেব্রুয়ারি, ২০১৪)। গান সংখ্য ৩০০৭। রাগ: শঙ্করা (বিলাবল ঠাট), তাল: ত্রিতাল। পৃষ্ঠা: ৯১৯।
- বেতার:
- মেল-মেলন কলকাতা বেতারকেন্দ্র। [২৮ ডিসেম্বর ১৯৩৯ (বৃহস্পতিবার ১২ পৌষ ১৩৪৬)। সান্ধ্য অনুষ্ঠান। ৭.২০-৮.০৪ মিনিট। চতুর্থ গান। বেলাওল ঠাট, রাগ শঙ্করা তেতালা]
[বেতার জগৎ-এর নমুনা পত্র]- সূত্র:
- বেতার জগৎ। ১০ম বর্ষ ২৪শ সংখ্যা। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৪০
- The Indian Listener Vol. IV. No 24, 7 December 1939. Page 1731
- সূত্র:
- মেল-মেলন কলকাতা বেতারকেন্দ্র। [২৮ ডিসেম্বর ১৯৩৯ (বৃহস্পতিবার ১২ পৌষ ১৩৪৬)। সান্ধ্য অনুষ্ঠান। ৭.২০-৮.০৪ মিনিট। চতুর্থ গান। বেলাওল ঠাট, রাগ শঙ্করা তেতালা]
- পর্যায়