মরালী-গমনশ্রী মদ-অলস চরণে (morali gomonshree mod-olosh chorone)
কে পূর্ণ-যুবতী গো চল নীর-ভরণে।
বেণী-বিলম্বিতা
উন্মনা অসম্বৃতা,
দেশকার লোভাতে চল মুনি-মন হরণে॥
পূর্বাচল-বিভাসিত গো তব গৌরী অঙ্গে,
ব্রজে তুমি কি বিরাজ কর গোপী-মাধব সঙ্গে।
পঞ্চমে পাপিয়া বোলে
চমকি’ থাম তরুতলে,
সরসী-নীরে কমল রাঙে তব অরুণ-বরণে।
- ভাবসন্ধান: এই গানটির বাণী দ্ব্যর্থক। এর একটি অর্থ পাওয়া যায়, কোনো এক পূর্ণ-যুবতী সুন্দরীর রূপে-বর্ণনা। এই সুন্দরীর চলনে কবি দেখতে পান জল আনতে যাওয়া কলসীকাঁখে অলস-মদির হংসীর রূপ। এর পিঠে ছড়ানো বিলম্বিতা বেণী। উন্মনা এবং শিথিলবসনা এই নারী মুনি-মন হরণকারিণী। কবি-কল্পনায় মনে প্রশ্ন জাগে এই সুন্দরী কে? এ কি ব্রজে কৃষ্ণের গোপিনী-সখা হিসেবে বিরাজ করে? কোকিল কিম্বা পাপিয়ার মধুর স্বর শুনে অভিসারের ভীত-চকিত রাধার চলন থেমে যায় বৃক্ষতলে। তার অরুণ-বরণ অঙ্গ-শোভায় দীঘির পদ্মফুল রঞ্জিত হয়ে ওঠে।
লক্ষণগীতি হিসেবে এই রাগের রূপ তুলে ধরা আগে, প্রাসাঙ্গিক কিছু বিষয় তুলে ধরা হলো। শাস্ত্র মতে বিভাস রাগটি চারটি ঠাটে পাওয়া যায়। এগুলো হলো- পূরবী, বিলাবল, ভৈরব ও মারবা। নজরুলের এই গানটি মারবা ঠাটের বিভাস। এই রাগের পূর্বাঙ্গে গৌরী এবং উত্তরাঙ্গে দেশকারের ছায়া পাওয়া যায়। নজরুল এই লক্ষণগীতিতে রাগের কাঠামোগত বিষয়ের চেয়ে ভাবগত সৌন্দর্য উপস্থাপন করেছেন। এই কারণে এরাগের বাদী, সমবাদী, অঙ্গ ইত্যদি নিয়ে কিছু বলেন নি।
রাগলক্ষণ বর্ণনায় প্রথমেই এই রাগের ঠাটের নাম উল্লেখ করা হয়েছে 'গমনশ্রী'। নজরুলের পাণ্ডুলিপিতে এ প্রসঙ্গে পাওয়া যায়- 'প্রাচীন সঙ্গীতশান্ত্রে ইহার নাম 'গমন শ্রম' মেল। গমন শ্রম কি 'গাওন শ্রম" - এর অপভ্রংশ?'
উল্লেখ্য প্রাচীন সঙ্গীতশাস্ত্রে মারোয়া ঠাটের সমতুল্য মেল ছিল 'গমনশ্রী'। সম্ভবত কবি মরালী শব্দটি বিভাসের রূপকার্থে ব্যবহার করেছেন। বঙ্গীয় শব্দকোষে [হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়] 'মরালী' শব্দের অর্থ দেওয়া হয়েছে রাজহংসী। মরাল-গমনশ্রী'র আক্ষরিক অর্থ হলো- রাজহংসীর মন্থরগমনের রূপ-সৌন্দর্য। অর্থা এই রাগের গতি মন্থর। এই রাগের ম এবং ধ বিশ্রান্তির স্থান। ফলে মদ-অলস (ম ও ধ-এর বিশ্রান্তিযু্ক্ত) চলনে এই রাগে বিলম্বিত এবং নান্দনিক রূপেরই ইঙ্গিত দেয়।
মরালী-গমনশ্রী পূর্ণ-যুবতী। অর্থাৎ রাগটি সম্পূর্ণ জাতীয়। তবে এর চলন সরল নয়, রমণীর বেণীর মতো প্যাঁচানো, অর্থাৎ বক্র এবং গতি বিলম্বিত। অন্যভাবে বিচার করলে পাওয়া যায় এই রাগের মন্দমধুর চলনে শৃঙ্গার রসের আভাষ। যেন সুন্দরীর পিঠে লুটিয়ে পড়া বিলম্বিতা বেণী। এই রাগের রূপ যেন, উন্মনা করে দেওয়া কোনো শিথিলবসনা নারীর মতো মুনি-মন হরণকারিণী। রাগের বিচারে 'দেশকার ভোলাতে চল মুনি-মন হরণ' পঙ্ক্তির অবলম্বনে প্রকাশিত হয়েছে- 'দেশকার' রাগের ছায়া এড়িয়ে চলার জন্য মা নি বর্জন করার বিধি।
'পূর্বাচল-বিভাসিত গো তব গৌরী অঙ্গে'-র দ্বারা বলা হয়েছে এই রাগের পূর্বাঙ্গে পাওয়া যায় গৌরী। উল্লেখ্য মারবা ঠাটের বিভাসে পূর্বাঙ্গ গৌরী এবং উত্তরাঙ্গে দেশকারের ছায়া পাওয়া যায়। এই রাগের 'গোপী মাধব' স্বরসঙ্গতি অর্থাৎ গ প এবং ম ধ স্বরসঙ্গতিতে রাগটি রূপমাধুর্য অনন্য মাত্রা পায়। এই রাগের সৌন্দর্য কতটা গভীর ব্যঞ্জনাময়, তা ব্যক্ত করতে গিয়ে, ব্রজের গোপী মাধব বা কৃ্ষ্ণের সৌন্দর্যের সঙ্গী কি না- এমন সংপ্রশ্নের মুখোমুখী হয়েছেন কবি। পঞ্চমস্বরে পাপিয়া সুমধুর বোল তুলে থেমে যায়। কারণ এই রাগের ন্যাস স্বর পঞ্চম। ক্ষণিকের পঞ্চমে এসে থামার জন্য, এই রাগ যেন তরুতলের মতো স্নিগ্ধ ও শান্ত আশ্রয় খুঁজে পায়।
এই রাগ পরিবেশনের সময় প্রভাত। বিভাস যেন দীঘির জলে ভাসা ভোরের অরুণ-বর্ণ বিভা ছড়ানো কমলের (পদ্ম) স্নিগ্ধ রূপের মতই প্রকৃতিকে রাঙিয়ে দেয়।
- রচনাকাল ও স্থান: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের [২৮ ডিসেম্বর ১৯৩৯ (বৃহস্পতিবার ১২ পৌষ ১৩৪৬) কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে নজরুলের রচিত ঠাট-ভিত্তিক 'মেল-মেলন' নামক গীতি-আল্লেখ্য প্রচারিত হয়। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ৪০ বৎসর ৭ মাস।
- গ্রন্থ: নজরুল-সঙ্গীত সংগ্রহ (নজরুল ইন্সটিটিউট, মাঘ, ১৪১৭/ফেব্রুয়ারি, ২০১৪)। গান সংখ্যা ১৬৭৬। রাগ: বিভাস (মারোয়া ঠাট)। পৃষ্ঠা: ৫০০।
-
বেতার:
-
মেল-মেলন কলকাতা বেতারকেন্দ্র। [২৮ ডিসেম্বর ১৯৩৯ (বৃহস্পতিবার ১২ পৌষ ১৩৪৬)। সান্ধ্য অনুষ্ঠান। ৭.২০-৮.০৪ মিনিট। ষষ্ঠ গান। মারোয়া ঠাট, রাগ বিভাস। সাদ্রা]
[বেতার জগৎ-এর নমুনা পত্র]- সূত্র:
- বেতার জগৎ। ১০ম বর্ষ ২৪শ সংখ্যা। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৪০
- The Indian Listener Vol. IV. No 24, 7 December 1939. Page 1731
- সূত্র:
-
- বিষয়াঙ্গ: রাগসঙ্গীত, লক্ষণগীত
- সুরাঙ্গ: খেয়ালাঙ্গ