শ্যামলা-বরণ বাংলা মায়ের (shyamla boron bangla maa er)
শ্যামলা বরণ বাংলা মায়ের রূপ দেখে যা, আয় রে আয়
গিরি-দরি, বনে-মাঠে, প্রান্তরে রূপ ছাপিয়ে যায়॥
ধানের ক্ষেতে, বনের ফাঁকে, দেখে যা মোর কালো মা-কে
ধূলি-রাঙা পথের বাঁকে বৈরাগিনী বীণ বাজায়॥
ভীরু মেয়ে পালিয়ে বেড়ায় পল্লীগ্রামে এক্লাটি
বিজনমাঠে গ্রাম সে বসায় নিয়ে কাদা, খড়, মাটি
কালো মেঘের ঝারি নিয়ে করুণা-বারি ছিটায়॥
কাজলা-দীঘির পদ্মফুলে যায় দেখা তার পদ্ম-মুখ
খেলে বেড়ায় ডাকাত-মেয়ে বনে লয়ে বাঘ-ভালুক
ঝড়ের সাথে নৃত্যে মাতে বেদের সাথে সাপ নাচায়॥
নদীর স্রোতে পাথর নুড়ির কাঁকন চুড়ি বাজে তার
সাঁঝের বারান্দাতে দাঁড়ায় টিপ প'রে সন্ধ্যা-তারার।
ঊষার গাঙে ঘট ভরিতে যায় সে মেয়ে ভোর বেলায়।
হরিত শস্যে লুটায় আঁচল ঝিল্লিতে নূপুর বাজে
ভাটিয়ালি গায় ভাটির স্রোতে গায় বাউল মাঠের মাঝে (মা)।
গঙ্গা-তীরে শ্মশান-ঘাটে কেঁদে কভু বুক ভাসায়॥
- ভাবসন্ধান: প্রকৃতি ও স্বদেশ পর্যায়ের এই গানে বাংলাদেশের অপরূপ চিত্র উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে, রূপকতা ও সৌন্দর্যের নন্দনিক সংমিশ্রণে। নদ-নদী বিধৌত বাংলার পাহাড় ও বন-প্রান্তরে যে রূপবৈচিত্র্য ছড়িয়ে রয়েছে, তা দেখে কবি মুগ্ধ। তাঁর এই মুগ্ধতার সহভাগী হওয়ার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান, এই গানের স্থায়ীতে ফুটে উঠেছে। এই ভাবনা থেকেই কবি পরবর্তী প্রতিটি অন্তরাকে সাজিয়েছেন রূপবৈচিত্র্যে ভরা বাংলার খণ্ড খণ্ড চিত্র দিয়ে।
ধানের ক্ষেতে, বন-বনান্তের ঘেরা ঘন শ্যামল বাংলাকে- কবি মাতৃরূপিণী কালো মেয়ের সাথে তুলনা করেছেন। আবার রাঢ় অঞ্চলের ধূলি-রাঙা পথের ধারে এই মাতৃরূপকে তিনি দেখেছেন বৈরাগিনী রূপে। বাংলার বিচিত্র রূপ ছড়িয়ে রয়েছে গ্রাম-গ্রামান্তের। একই রূপে ধরা দেওয়ার ভয়ে বহুরূপিণী বঙ্গজননী যেন পলাতকা ঘুড়ে বেড়ান। এই রূপবৈচিত্র্য দিয়েই তিনি জনহীন প্রান্তরে কাদা-খড়-মাটি দিয়ে বসতি গড়ে তোলেন। তাঁর কালো মেঘের ঝারি থেকে অবিরাম করুণার বর্ষণে নির্জলা প্রান্তরকে উর্বর করে তোলেন। কবি কাজলা দীঘির পদ্মফুলে, বনে-বাদারে বাঘ-ভালুকের সদর্প পদসঞ্চারে, বেদের সাপের খেলার মতো ঝড়ের উদ্দাম নৃত্যে বাংলাকে দেখতে পান। খরস্রোতা পাহাড়ি নদীর স্রোতের শব্দে কবি খুঁজে পান বাংলা-মায়ের কাঁকনের শব্দ, সন্ধ্যাকাশের সন্ধ্যাতারা যেনো টিপ হয়ে তার কপাল শোভিত করে। আবার ভোরের সোনার আলোর ঘট ভরিয়ে ঊষাময়ীরূপে দেখা দেন তিনি। তাঁর অঞ্চল ভরে থাকে পাকা ধানের রাশি। সন্ধার ঝিল্লির ধ্বনি হয়ে উঠে তাঁর নূপুরের ধ্বনি। প্রকৃতির অপার রূপরাশির সৌন্দর্য বৈভবে সমৃদ্ধ বাংলা মায়ের রূপ সন্দর্শনে অভিভূত সন্তানেরা বাউল-ভাটিয়ালির সুরসৌরভে মাতোয়ারা হন। আবার প্রিয়জনের চিরবিদায়ের বেদনার সমব্যথী হয়ে বঙ্গজননী যেন ক্রন্দসী হয়ে বিলাপ করেন।
বঙ্গজনপদের সকল রূপ ধারণ করে এই গানের বঙ্গ হয়ে উঠেছে বহুরূপিণী বঙ্গজননী। এই গানটি যেন হয়ে উঠেছে প্রকৃতি ও স্বদেশের মেলবন্ধনে গাঁথা একটি নকশীকাঁথা।
- রচনাকাল ও স্থান: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। ১৩৩৯ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে প্রকাশিত 'সুর-সাকী' গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গানটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ৩৩ বৎসর ১ মাস।
- গ্রন্থ:
- সুর-সাকী
- প্রথম সংস্করণ [আষাঢ় ১৩৩৯ বঙ্গাব্দ। জুলাই ১৯৩২)]
- নজরুল রচনাবলী, জন্মশতবর্ষ সংস্করণ, চতুর্থ খণ্ড। বাংলা একাডেমী, ঢাকা। [জ্যৈষ্ঠ ১৪১৮, মে ২০১১। সুর-সাকী। ৬৬ সংখ্যক গান। ভৈরবী- কার্ফা। পৃষ্ঠা ২৬৩-২৬৪]
- সুর-সাকী
- রেকর্ড: এইচএমভি। সেপ্টেম্বর ১৯৩২ (ভাদ্র-আশ্বিন ১৩৩৯)। এন ৭০২৩। শিল্পী: ধীরেন্দ্রনাথ দাস। [শিল্পীঃ খাইরুল আনাম শাকিল (শ্রবণ নমুনা)]
- স্বরলিপিকার ও স্বরলিপি: সুধীন দাশ । নজরুল-সঙ্গীত স্বরলিপি তৃতীয় খণ্ড। প্রথম প্রকাশ, দ্বিতীয় মুদ্রণ [নজরুল ইন্সটিটিউট। বৈশাখ ১৪০২। এপ্রিল ১৯৯৬। পৃষ্ঠা: ২১ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা: ১০০-১০৫] [নমুনা]
- পর্যায়:
- বিষয়াঙ্গ: প্রকৃতি ও স্বদেশ
- সুরাঙ্গ: স্বকীয় বৈশিষ্ট্যর গান
- তাল: দ্রত দাদরা
- গ্রহস্বর: পা