ওমা পেঁচা যদি খ্যাঁচ খ্যাঁচায়

ওমা পেঁচা যদি খ্যাঁচ খ্যাঁচায় মা মাচায় উঠিয়া বসি,
 বউ যদি হাঁচে ফ্যাঁচ ক'রে ভয়ে কাছা পড়ে খসি।
 ঘুটঘুটে এই অন্ধকারে (মা) হৃদয় হ'য়েছে ঘুঁটে।
 অঙ্গ কুঁচকে হ'য়েছে পুঁচকে হাত পা হ‌'য়েছে কুটে।
 প্রতি পদে পথে পতনের ভয় আপনি দুই পা নাচে,
 দেখি ভাঁড় ভরা ধেনো মাড় খেয়ে, ষাঁড় পাঁড় হয়ে পড়ে আছে।
 হাত থাকতে হয়েছিস্‌ মাগো শ্রীজগন্নাথ ঠুঁটো,
 পাছে ক্ষুধায় জ্ব'লে ছেলেরা তোর ভাত চায় দু'মুঠো।
 দশ হাত তোর বাতে অবশ কি আর দিবি বল?
 দেবার মধ্যে দিয়েছিস মাগো শুধুই চোখের জল !
 আঁধার রাতি নেইকে| বাতি ঠাকুর দেখবে কে?
 দেওয়ালী তোর জ্ব'লবে সেদিন দেয়াল ভেঙ্গেদে
                                 [মা দেয়াল ভেঙ্গেদে!]
 
 এ মন আঁধারের দেয়াল ভেঙ্গেদে!
 পথ ঘাট আজ তিমির ঘের৷ সর'ছে ঘরের মাল
 ঘরের আলো নিবলো এবার প্রাণের আলো জ্বাল ॥
                                 [মা গো- প্রাণের আলো জ্বাল]

  • ভাবসন্ধান: বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের রচিত রঙ্গনাটক 'ব্ল্যাক আউট' -এ এই গানটিতে পাওয়া যায় সমকালীন কলকাতার বিদ্যুৎ বিভ্রাটের নিপুণ চিত্র। অন্ধকারে আচ্ছন্ন নগরবাসী নানারূপ অঘটনের আশঙ্কায় সাধারণ ঘটনাকে ভয় পেতে অভ্যস্থ হয়ে ওঠে। দেবীর কাছে নগরবাসীর এই দুর্ভোগ উপস্থাপিত হয়েছে- রঙ্গার্থে। গানটিতে কবি বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন নগরবাসীর প্রতিনিধি হয়ে। এই গানের উপসংহারে এসে কবি দেবীর কাছে সুমঙ্গলের আলো জ্বালিয়ে দিয়ে সকল ব্ল্যাকআউটের অবসান প্রার্থনা করেছেন।

    অন্ধকারে যখন স্বাভাবিকভাবে পেঁচা খ্যাঁচ করে করে ডাকে, তখন নগরবাসী ভয়ে অঘটনের ভয়ে মাচায় উঠে বসে। আর ঘরের বৌ-ও যদি হাঁচি দেয় তাহলে ভয়ে পরনের কাছা খসে পড়ে। এমন ঘুটঘুটে অন্ধকারে তাদের মনও ঘুঁটে (শুকনো গোবর) হয়ে গেছে। ভয়ে সলের সর্বাঙ্গ কুঁচকে গিয়ে তাদের পুচকে হাত হয়ে গেছে কুটোর মতো। চলতে গেলে পড়ে যাওয়ার ভয়ে, পা দুটি আপনি নাচতে থাকে। স্বাভাবিক খাদ্যের অভাবে, ভাঁড় ভরা ভাতের পচা মাঁড় খেয়ে, ষাঁড় পাঁড় মাতাল হয়ে পড়ে আছে। এতসব দেখেও দেবী হাত তুলে বর বা প্রতিকার করার বদলে- শ্রীজগন্নাথ ঠুঁট (অকর্মণ্য) হয়ে বসে আছেন। পাছে নগরবাসী ক্ষুধার জ্বালায় তাঁর কাছে অন্ন প্রার্থনা করে। আক্ষেপ, দেবীর দশহাত যেন বাতে অবশ হয়ে গেছে, সে আর কি দেবে। তাঁর দেবার মতো আছে শুধু নগরবাসীর চোখে বেদনার্ত চোখের জল। পথঘাট ব্ল্যাক আউটে গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত। এর ভিতরের চোরের দল চুরি করে চলেছে।

    কবি মনে করেন- প্রকৃত দেওয়ালী উৎসব সেদিনই ঘটবে, যেদিন শ্যামা রূপিণী দেবী সকল অকল্যাণের অন্ধকার-দেওয়াল ভেঙে নগরবাসীর জন্য মুক্তি বয়ে আনবেন। এত আক্ষেপের পরেও দেবীর কাছে কবির প্রার্থনা- ব্ল্যাক  আউটে ঘরের বাতি নিভে গেছে, এবার মনের অন্ধকার দূর করার জন্য প্রাণের আলো জ্বালানোর জন্য। এই আলো- জ্ঞান, সুবুদ্ধির ও সুকল্যাণের।  মানুষ নিজ নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য নিজেদেরকে আলোহীন অন্ধকারে নিমজ্জিত করেছে। সেখানে দেবী অসহায়া। তাই তিনি যদি সবার মনে সুকল্যাণময় জ্ঞানের আলো জ্বালাতে পারেন, তবেই সকল ব্ল্যাক আউট দূর হয়ে যাবে। তবেই সকলের মনের ঘরে এবং নগরীর সবার ঘরে ঘরে জ্বলে উঠবে সুকল্যাণের আলো ।

     
  • রচনাকাল ও স্থান: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের আগষ্ট (ভাদ্র ১৩৪৮), কলকাতার মিনার্ভা মঞ্চে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের রচিত রঙ্গনাটক 'ব্ল্যাক আউট'-এ এই গানটি প্রথম ব্যবহৃত হয়েছিল। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ৪২ বৎসর ৩ মাস।
  • গ্রন্থ:
    • ব্ল্যাক্-আউট। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। [ষ্ট্যান্ডার্ড বুক কোম্পানী ২১৩, কর্ণওয়ালিশ ষ্ট্রীট্, কলকাতা]  ভুতশ্বরের গান। পৃষ্ঠ: ৬১
    • নজরুল-সংগীত সংগ্রহ [রশিদুন্‌ নবী সম্পাদিত। কবি নজরুল ইন্সটিটিউট। তৃতীয় সংস্করণ দ্বিতীয় মুদ্রণ, আষাঢ় ১৪২৫। জুন ২০১৮। গান সংখ্যা ৩২৬৩। তাল: ফের্‌তা (দ্রুত-দাদ্‌রা ও কাহার্‌বা)]
  • মঞ্চনাটক: মিনার্ভা থিয়েটার। আগষ্ট ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দ (ভাদ্র ১৩৪৮)। ভূতেশ্বরের গান
  • রেকর্ড: এইচএমভি। ১৯৪১ অক্টোবর (আশ্বিন-কার্তিক) এন ২৭২০৬। রঞ্জিত রায়
  • পর্যায়
    • বিষয়াঙ্গ: ধর্মসঙ্গীত। সনাতন হিন্দুধর্ম। দুর্গা।দুর্গা-পূজা। প্রার্থনা

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।