বঁধু হে বঁধু ফিরে এসো
বঁধু ফিরে এসো, আজো প্রাণের প্রদীপ রেখেছি আঁচল ঢেকে
বিরহ-নিঃশাসে দীরঘ বাতাসে কেঁপে ওঠে থেকে থেকে ।
আর রাখতে নারি নিবু নিবু দীপ রাখতে নারি
বুঝি আমার পরান-প্রদীপ নিভাবে আমারি নয়ন-বারি।
বঁধু যমুনারই তীরে আসি ফিরে ফিরে কাঁদি কদম-তরু-তলে
হেরি বালুচরে বেণু আছে প’ড়ে ডাকে না আর রাধা ব’লে।
অভিমানে বাঁশি আমার বুকে আসি কেঁদে কেঁদে কহে যেন গো
হরি আরাধিকা রাধিকা এলে যদি শ্রীহরি এলো না কেন গো!
পায়ে ধ’রে কাঁদে এসে যমুনার ঢেউ
বলে- যমুনা সিনানে আর আসে না তো কেউ
জটিলা কুটিলা আজ কলহ ভুলে
জড়াইয়া মোরে কাঁদে যমুনা-কূলে
বলে- কৃষ্ণ কই লো
কলহেরি তরে আর লইব কার নাম।
এই বিরহ-যমুনা পার হব কবে বলো হে বিরহী মম
গেলে কোন সে গোলকে রহিবে চোখে চোখে
প্রিয়তম হে কৃষ্ণ আঁখি-তারা সম॥
- ভাবার্থ: কোনো এক অজ্ঞাত কারণে দীর্ঘদিন কৃষ্ণ রাধার সান্নিধ্যে আসে নি। কৃষ্ণহীন রাধার অপার বিরহ-বেদনা এই গানে উপস্থাপন করা হয়েছে। কৃষ্ণ বিরহিণী রাধার আকুলতা দিয়ে শুরু হয়েছে এই গান। বলছে 'বঁধু ফিরে এসো'। দীর্ঘ দিন কৃষ্ণ না এলেও রাধা তার প্রাণের প্রণয়-প্রদীপ প্রেমের-আঁচলের আবরণে জ্বালিয়ে রেখেছে। তবু শাশ্বত প্রেমের অকম্পিত প্রদীপ কখনো কখনো বিরহের অভিঘাতে কেঁপে কেঁপে ওঠে। অসহনীয় বিরহ-বেদনায় মূহ্যমানা রাধার মনে সংশয় জাগে, হয়তো এ প্রণয়-প্রদীপের শিখা জালিয়ে রাখতে পারবে না সে। কারণ হয়তো তার বিরহ-বেদনার অশ্রুতেই এই পরান-প্রদীপ নিভে যাবে।
রাধার এই বিরহবেদনার অপরূপ চিত্ররূপ উপস্থাপিত হয়েছে- এই গানের অন্তরা থেকে। বিরহিণী রাধা প্রেম-লীলার স্মৃতি বিজড়িত যমুনা তীরের কদমতলায় আসে এবং কৃষ্ণের অদর্শনে বিলাপ করে। কারণে সেখানে কৃষ্ণের বাঁশী পড়ে আছে, কৃষ্ণ নেই। যে বাঁশির সুরে ছিল রাধার সান্নিধ্য পাওয়ার আহ্বান, সে বাঁশি পরিত্যাক্ত হয়ে পড়ে আছে। এই পরিত্যাগ শুধু বাঁশির নয়, এর ভিতরে রয়েছে রয়েছে রাধাকে ত্যাগ করার বেদনা। রাধার অভিমানের সঙ্গী হয়ে যেন এই বাঁশির সুর বুকের ভিতরে বাজে। সে বাঁশি রাধার কাছে অনুযোগের সুরে বলে- হে হরি আরাধিকা রাধা, তুমি তো এলে, কিন্তু বংশীধারী এলো না কেন? এই অনুযোগ শুধু বালুচরে পড়ে থাকা বাঁশীর নয়, যমুনারও। যমুনার প্রত্যাশা শুধু রাধা ও তার সহচীদের যমুনা কূলে আসা নয়, তার জলে নেমে রাধা স্নান করুক এমনি আকাঙ্ক্ষাও। যমুনা কূলে রাধা ও তার সহচরীরা কেউ স্নানে নামে না। জটিলা কুটিলা যমুনার তীরে রাধাকে জড়িয়ে ধরে বিলাপ করে, কিন্তু স্নানে নামার উৎসাহ পায় না। কারণ যে কৃষ্ণের নাম নিয়ে তারা কলহ করবে, সেই কৃষ্ণই যদি না থাকে, তাহলে স্নান-লীলার আনন্দ কোথায়? তাই এদের কাছে লীলাময়ী যমুনা হয়ে উঠে বিরহ-যমুনা। আঁখিতারা-সম প্রিয়তম কৃষ্ণ-বিহীন রাধা আর সখিদের কাছে- প্রেম-যমুনা হয়ে ওঠে অপার বিরহ-যমুনা। এখানে যমুনা শুধুই নদী নয়। এ যমুনা রাধা-কৃষ্ণের প্রবহমান প্রেমলীলারও প্রতীক।
- রচনাকাল ও স্থান: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর (ভাদ্র-আশ্বিন ১৩৪৮) মাসে, হিন্দুস্তান রেকর্ড কোম্পানি থেকে গানটির প্রথম রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছিল। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ৪২ বৎসর ৩ মাস।
- গ্রন্থ: নজরুল-সঙ্গীত সংগ্রহ, [নজরুল ইনস্টিটিউট, মাঘ ১৪১৮। ফেব্রুয়ারি ২০১২। গান সংখ্যা ৮৫৪ ও ৩০৭৯ । পৃষ্ঠা: ২৬২ ও ৯৪২।
- রেকর্ড: হিন্দুস্তান [ সেপ্টেম্বর ১৯৪১ (ভাদ্র-আশ্বিন ১৩৪৮)]। এইচ ৯৪৭। শিল্পী: গৌরী বসু। সুর: নজরুল।
- পর্যায়:
- বিষয়াঙ্গ: ধর্মসঙ্গীত। সনাতন হিন্দুধর্ম, বৈষ্ণব। লীলা-কীর্তন
- সুরাঙ্গ: কীর্তনাঙ্গ
- তাল: তালফেরতা (দাদরা, কাহারবা, তেওরা)