আমায় নহে গো - ভালবাস শুধু ভালবাস মোর গান (amay nohe go - bhalobasho shudhu bhalobasho mor gaan )

আমায় নহে গো - ভালবাস শুধু ভালবাস মোর গান।
বনের পাখিরে কে চিনে রাখে গান হ'লে অবসান॥
চাঁদেরে কে চায় - জোছনা সবাই যাচে,
গীত শেষে বীণা প'ড়ে থাকে ধূলি মাঝে;
তুমি বুঝিবে না বুঝিবে না -
আলো দিতে পোড়ে কত প্রদীপের প্রাণ॥
যে কাঁটা-লতার আঁখি-জল, হায়, ফুল হ'য়ে ওঠে ফুটে -
ফুল নিয়ে তায় দিয়েছ কি কিছু শূন্য পত্র-পুটে !
সবাই তৃষ্ণা মিটায় নদীর জলে,
কী তৃষা জাগে সে নদীর হিয়া-তলে -
বেদনার মহাসাগরের কাছে কর সন্ধান॥

  • ভাবসন্ধান: সৃজনশীল শিল্পকর্মে শিল্পীর চেয়ে শিল্প মহান, শিল্পীর এই চিরন্তন অভিমানই এই গানে মূর্ত হয়ে উঠেছে। শিল্পীর সৃষ্ট বা গীত গানের অমিয়ধারায় স্নাত বিমুগ্ধ শ্রোতা, প্রবল মুগ্ধতায় যেমন করে বার বার আনন্দ-সঙ্গমে মত্ত হয়ে উঠে, তেমনি করে শিল্পীকে মননে ধারণ করেন না। বনের পাখির সুমধুর গান শেষে যেমন পাখিকে শ্রোতা ভুলে যায়, তেমনি সঙ্গীতশিল্পীর উপস্থাপিত গান শোনার পর শ্রোতারাও শিল্পীকে ভুলে যায়।

    গানটির স্থায়ীর এই অভিমানই অন্তরাতে এসে নতুন কিছু উপমায় পুনারবৃ্ত্তি হয়েছে। চাঁদের মোহময়ী জ্যোছনার সৌন্দর্যকে সবাই যেমন ক'রে কামনা করে, চাঁদকে তেমনি ক'রে কেউ চায় না। আর যে বীণার অনুষঙ্গে গীত গান হয়ে ওঠে অমৃতবর্ষী, গান শেষ সে বীণাও ধুলার মাঝে ধুলার মতো অবহেলায় পড়ে থাকে। অন্তরার শেষে কবি সৃষ্টির বেদনার কথা স্মরণ দিয়েছেন আলোপ্রদায়ী প্রদীপের আত্মবিসর্জনের উপমায়। যে কোন মহৎ সৃষ্টির পিছনে রয়েছে যে সৃজনবেদনা, তা একমাত্র শিল্পীই জানেন। সৃষ্টির সাথে সাথে স্রষ্টাকে যদিও কেউ কেউ অভিবাদন জানান বটে, কিন্তু সৃষ্টির সৃজনবেদনাকে কেউ জানতে চান না।

    যে কাঁটালতার অশ্রুসজল বেদনার গভীর থেকে সৃষ্টির মহিমান্বিত শিল্পপুষ্প বিকশিত হয়, তার গন্ধ-স্পর্শ-সৌন্দর্যে সবাই আপ্লুত হয়ে উঠে। কিন্তু কেউ শিল্পীর শিল্প-মনলোকের বৃন্তচ্যুত পুষ্পের অপূর্ণতা পূর্ণ করার কথা কেউ ভাবে না। গানটির আভোগে শিল্পীর প্রতি অবহেলাকে উপস্থাপন করা হয়েছে নতুন উপমায়। শিল্প-সৌন্দর্য উপভোগে যে তৃষ্ণা জেগে উঠে, শিল্পী তাঁর শিল্পকর্মের মধ্য দিয়ে তা নিবারণ করেন। কিন্তু শিল্পীরও রয়েছে সৌন্দর্যে তৃষ্ণা। কিন্তু কেউ তাঁর খোঁজ রাখে না। কবি মনে করেন শিল্পীর তৃষ্ণার সন্ধান সহজলভ্য নয়। একটি একক সৃষ্টির পিছনে থাকে হয়তো একটি মাত্র ক্ষুদ্র সৃষ্টির বেদনা। কিন্তু শিল্পীর সৌন্দর্যসৃষ্টির কামনা অসীম। তাই তাঁর বেদনাও মহাসাগরের মতই অসীম। অভিমানী কবিও এই গানের শেষ পংক্তিতে হয়ে উঠেছেন অসীম বেদনার ধারক।  কবিরে এই অসীম অভিমানের বেদনা মহাসাগরে অতলস্পর্শীর মহিমায় মহিমান্বিত। শিল্পভোক্তাকে সেই অসীম বেদনার মহাসাগরে সন্ধান দিয়ে কবি এই গানের সমাপ্তি টেনেছেন।

     
  • রচনাকাল ও স্থান: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ১২ মে (রবিবার, ২৯ বৈশাখ ১৩৪৭), কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে গানটি মৃণালকান্তি ঘোষ পরিবেশন করেছিলেন। এই সময় নজরুল ইসলামের বয়স ছিল ৪০ বৎসর ১১ মাস।
     
  • বেতার:
    •  একক পরিবেশনা। শিল্পী মৃণালকান্তি ঘোষ। কলকাতা বেতারকেন্দ্র। ১২ মে ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দ (রবিবার, ২৯ বৈশাখ ১৩৪৭)।  প্রাতঃকালীন অধিবেশন। সকাল ৯.০০-৯.১৪টা।
      [সূত্র: বেতার জগত। ১১শ বর্ষ, ৯ম সংখ্যা [শনিবার, ১ মে, ১৯৪০] পৃষ্ঠা: ৪৮৬]
       
    • অতনুর দেশ। গীতিচিত্র। কলকাতা বেতারকেন্দ্র।  ৮ জুন ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দ (শনিবার, ২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৭), কলকাতা বেতার কেন্দ্রে সান্ধ্য অধিবেশন। সময় সন্ধ্যা ৭.০০-৭.৪৪টা।
      [সূত্র: বেতার জগত। ১১শ বর্ষ, ১১শ সংখ্যা [শনিবার, ১ জুন, ১৯৪০। ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৭] পৃষ্ঠা: ৫৯৫]
  • রেকর্ড: এইচএমভি [অক্টোবর ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দ (আশ্বিন-কার্তিক ১৩৪৯)]। এন ২৭৩২৩। শিল্পী: সন্তোষ সেনগুপ্ত। সুর শৈলেশ দত্তগুপ্ত] [শ্রবণ নমুনা]
  • সঙ্গীতবিষয়ক তথ্যাবলি:
    • সুরকার:
      • নজরুল ইসলাম। [কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারিত তথ্য অনুসারে]।
      • শৈলেশ দত্তগুপ্ত। [নজরুল সুরলিপি, দ্বিতীয় খণ্ড, ৬ সংখ্যক গান (নজরুল একাডেমী, মে ১৯৮২)। পৃষ্ঠা: ১৪-১৬]।
  • স্বরলিপি ও স্বরলিপিকার:
  • পর্যায়:
    • বিষয়াঙ্গ: প্রেম
    • সুরাঙ্গ: স্বকীয় বৈশিষ্ট্য (মুলতানী রাগের সুরবিন্যাস লক্ষ্য করা যায়)

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।