আমার কালিবাঞ্ছা কল্পতরুর ছায়াতলে আয় রে (amar kalibancha kolpotorur chayatole ay re)

আমার কালিবাঞ্ছা কল্পতরুর ছায়াতলে আয় রে,
এই তরুতলে যে যাহা চায় তখনি তা পায় রে॥
            তুই চতুর্বর্গ ফল কুড়াবি
            যোগ পাবি, ভোগ পাবি
এমন কল্পতরু থাকতে ─ কেন মরিস্ নিরাশায় রে॥
দস্যু ছেলের আবদারে সে সাজে ডাকাত কালির বেশে,
কত রামপ্রসাদের কন্যা হয়ে বেড়া বেঁধে যায় রে।
            ওরে পুত্র-কন্যা বিভব-রতন,
            চেয়ে নে যার ইচ্ছা যেমন,
ওরে আমার এ মন থাকে যেন বাঞ্ছাময়ীর পায় রে॥
            সে আর কিছু না চায়
        চেয়ে চেয়ে বাসনা তার শেষ হল না হায়!
এবার খালি হাতে তালি দিয়ে (আমি) চাইব কালিকায় রে॥

  • ভাবসন্ধান: হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে- কল্পতরু হলো- ইচ্ছা পূরণকারী বৃক্ষ। অমৃত লাভের আশায় দেবাসুরের সমুদ্র মন্থনকালে উত্থিত হয়েছিল এই বৃক্ষ। সমুদ্রমন্থনের পর্ব শেষ হওয়ার পর, দেবরাজ ইন্দ্র এই গাছটি  তাঁর নন্দন কাননে রোপণ করেন। অন্য মতে- কল্পতরু ইন্দ্রলোকে পাঁচটি কল্পতরু রয়েছে। সেগুলি হলো - মন্দনা, পারিজাত, সন্তান, কল্পতরু ও হরিচন্দন। এর সবগুলিই বিভিন্ন ইচ্ছা পূরণকারী হিসেবে মান্য করা হয়। গানটির শেষে পাওয়া যায় পরম ভক্তিতে ভক্তের আত্মনিবেদন।

    রূপকার্থে এই গানের কল্পতরু হলো কালীবাঞ্ছা। কারণ, সর্ব-প্রদায়িনী কালীর কাছে যে কোনো কিছু পাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে, তা অপূরণ থাকে না। হিন্দু দর্শনে চতুর্বর্গ ফল হলো- ধর্ম (ধার্মিকতা, নৈতিক মূল্যবোধ), অর্থ (সমৃদ্ধি, অর্থনৈতিক মূল্যবোধ), কাম (আনন্দ, প্রেম, মনস্তাত্ত্বিক মূল্যবোধ) এবং মোক্ষ (মুক্তি, আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ, আত্ম-উপলব্ধি)। কবি মনে করেন এই কালীবাঞ্ছা কল্পতরুতে রয়েছে চতুর্বর্গ ফল। কল্পতরুর ফলে  যোগ (ধর্ম)  ভোগ (কাম) পাওয়া যায়। তাই কবি কালীভক্তদের উদ্দেশ্যে বলছেন- এই কল্পতরু এলে নিরাশ হওয়ার কোনো আশঙ্কা থাকে না।

    এ দেবী ভক্তের ইচ্ছা পূরণের জন্য কখনো ডাকাত কালী হন, কখনো রামপ্রসাদের বেড়া বাঁধার সহায়িকা কন্যা হন। বিপরীতমুখী এ দুটি উপমার দ্বারা কবি দেবীর সর্বপ্রদায়িনী রূপ তুলে ধরেছেন। এর একদিকে  রয়েছে ডাকাতকালীর কথা। উল্লেখ্য, একসময় বাংলার ডাকাতরা ডাকাতির আগে ডাকাতকালীর পূজা দিতো। এই পূজায় অর্ঘ হিসেবে নিবেদিত হতো নরবলি। অপর উপমাটি কবি ব্যবহার করেছেন- কালীভক্ত রামপ্রাসদের লোকরঞ্জিত কাহিনি থেকে। কথিত আছে এই দেবী কন্যা  হয়ে সাধক রামপ্রসাদের ভাঙা বেড়া বাঁধতে সাহায্য করেছিলেন। 

    কবি কালীভক্তদের মনে করেন- পুত্র-কন্যা বিভব-রতন ইত্যাদি পাওয়ার যত ইচ্ছা, সবই  বাঞ্ছাময়ী দেবী পূর্ণ করে দেবেন। তাই এই গানe কবি সবাইকে এই কল্পতরুর তলে আসার আহ্বান করেছেন।

    এই গানের উপসংসারে কবি তাঁর আত্মোপলব্ধিতে বলেছেন- সংসারে ভক্তের আকাঙ্ক্ষার শেষ নেই। তাই সকল আকাঙ্ক্ষা বিসর্জন দিয়ে- খালি হাতে (বাসনা শূন্য হাতে), কবি শধু কালীকেই মাতৃরূপে চাইবেন। কারণ স্বয়ং কালীকে পাওয়ার অর্থই হলো- সবকিছুই পাওয়া।

     
  • রচনাকাল ও স্থান:  গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। ১৯৪৩ বঙ্গাব্দের ফেব্রুয়ারি (মাঘ-ফাল্গুন ১৩৪৯) মাসে  এইচএমভি রেকর্ড কোম্পানি থেকে গানটির প্রথম রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছিল। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল  ৪৩ বৎসর ৮ মাস।
     
  • রেকর্ড: এইচএমভি। ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩ (মাঘ-ফাল্গুন ১৩৪৯)। এন ২৭৩৫২। শিল্পী: মৃণালকান্তি ঘোষ [শ্রবণ নমুনা]
     
  • স্বরলিপি ও স্বরলিপিকার: ইদ্‌রিস আলী [ নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপি, দ্বাবিংশ খণ্ড, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা ভাদ্র, ১৪০৭/ সেপ্টেম্বর, ২০০০ খ্রিষ্টাব্দ] প্রথম গান। [নমুনা]
     
  • সুরকার: কমল দাশগুপ্ত
  • পর্যায়:
    • বিষয়াঙ্গ: ধর্মসঙ্গীত। সনাতন হিন্দুধর্ম। শাক্তসঙ্গীত। শ্যামা সঙ্গীত। আত্মনিবেদন
    • সুরাঙ্গ: স্বকীয়
    • তাল: দাদরা
    • গ্রহস্বর: সা

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।