আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন।

           রাগ: জৌনপুরী, তাল: দাদ্‌রা

 আমার         কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন।
(তার)     রূপ দেখে দেয় বুক পেতে শিব যার হাতে মরণ বাঁচন॥
                        কালো মায়ের আঁধার কোলে
                        শিশু রবি শশী দোলে
(মায়ের)  একটুখানি রূপের ঝলক স্নিগ্ধ বিরাট নীল-গগন॥
            পাগলী মেয়ে এলোকেশী নিশীথিনীর দুলিয়ে কেশ
            নেচে বেড়ায় দিনের চিতায় লীলার রে তার নাই কো শেষ।
                        সিন্ধুতে মা’র বিন্দুখানিক
                        ঠিক্‌রে পড়ে রূপের মানিক
            বিশ্বে মায়ের রূপ ধরে না মা আমার তাই দিগ্‌-বসন॥

  • ভাবার্থ: এই গানে কবি হিন্দু পৌরাণিক দেবী কালীর বিশ্বরূপা আদ্যাশক্তির মহিমা নানা রূপকতার মধ্য দিয়ে উপস্থাপন করেছেন। কালী মূলত আদ্যাশক্তি দুর্গার রূপ বিশেষ।

    শুম্ভ-নিশুম্ভ নামক অসুরের সাথে দ্বন্দ্ব উপস্থিত হলে- শুম্ভ-নিশুম্ভ দেবীকে ধরে আনার জন্য চণ্ড-মুণ্ডকে পাঠান। হিমালয়ের শিখরে তাঁরা দেবীকে আক্রমণ করলে- দেবীর ললাট থেকে কালী'র আবির্ভাব হয়। এই সময় তিনি কালীরূপ-সহ দশটি রূপ ধরে দুর্গা অসুরদের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। এই দশটিরূপকে দশটি নামে অভিহিত করা হয়। এই নামগুলো হলো- দিগম্বরী, আকর্ণনয়না, পূর্ণযৌবনা, মুক্তকেশী, লোলজিহবা, মুণ্ডমালাবিভুষিতা, চতুর্ভুজা, শ্যাম বর্ণ ও কালী। এই দেবী চণ্ড-মুণ্ডকে হত্যা করে দুর্গার মূল মূর্তির কাছে ফিরে গেলে, দুর্গা তাঁকে চামুণ্ডা (চণ্ড-মুণ্ডকে হত্যা করার কারণে) নামে অভিহিত করেন। উল্লেখ্য অম্ (সূক্ষ্ম) রূপযুক্তা- এই অর্থে কালীর অপর নাম অংস্বরূপা।

    অশুভ শক্তির বিনাশিনী-রূপে কালী-উপাসকরা কালীকে মাতৃরূপে পূজা করে থাকেন। কবি এই গানে এই ভক্তিদর্শনে কালীকে উপস্থাপন করেছেন। কালীর গায়ের রঙ কালো। কালীর পায়ের তলায় কল্যাণের শুভ্রজ্যোতি বিরাজ করে। সে উৎসমূলে বিরাজ করে জ্যোতির্ময় জগতের ছন্দেবন্ধে নৃ্ত্যলীলা। গানটির স্থায়ীর প্রথম পংক্তির পরেই রয়েছে- কালীর পায়ের তলায় তাঁর স্বামীর শিবের শয়নের কথা। এর পিছনে রয়েছে কালীর ভয়ঙ্করীরূপের আরও একটি পৌরাণিক উপখ্যান। এই উপাখ্যানটি হলো-

    'রক্তবীজ' নামক এক অসুরের সাথে দেবতাদের যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে দেবতাদের পরাজয় অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। কারণ ব্রহ্মার বরে রক্তবীজের একফোঁটা রক্ত থেকে জন্ম নিচ্ছিল আরো হাজার রক্তবীজ-রূপী অসুর। এই অবস্থায় দূর্গা যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং তাঁর দুই ভ্রূ-এর মাঝখান থেকে জন্ম নেন দেবী কালী। কালী বহু অসুরকে হত্যা করলেও রক্তবীজ অপরাজেয় থাকেন। রক্তবীজের একফোঁটা রক্তও যাতে ভূমিতে না পড়ে, সেই কারণে কালী রক্তবীজের দেহনিঃসৃত রক্ত পান করতে থাকেন। পরে রক্তবীজের দেহ শূন্যে তুলে নেন এবং এই অবস্থায় রক্তবীজের দেহের সবটুকু রক্তপান করেন। শেষ বিন্দু রক্ত পান করার পর নিথর রক্তশূন্য রক্তবীজের দেহ ছুড়ে ফেলে দেন। এরপর তিনি বিজয়নৃত্য শুরু করেন এবং নিহত অসুরের হাত দিয়ে তিনি কোমড়বন্ধনী এবং মাথা দিয়ে মালিকা বানিয়ে পরিধান করেন। কালীর এই প্রলয়ঙ্করী নাচ দেখে দেবতারা শঙ্কিত হয়ে পড়েন। তাঁরা সৃষ্টিকে রক্ষা করার জন্য, কালীর স্বামী শিবের শরণাগত হন । শিবের একাধিক মৌখিক অনুরোধ অগ্রাহ্য করেও কালী উন্মাদিনীর মতো নাচতে থাকেন। কোনও উপায় না দেখে শিব নৃত্যরতা কালীর পায়ের তলায় শুয়ে পড়েন। এরপরই পায়ের নিচে স্বামীকে দেখে লজ্জায় তিনি জিভ কাটেন এবং উন্মত্ত নৃত্য বন্ধ করেন।

    অন্তরাতে কবি কালীকে স্নেহময়ী মাতৃরূপে উপস্থান করেছেন। যেহেতু কালী জগৎমাতা। তিনিই সৃষ্টি করেছেন চন্দ্র, সূর্যাদি। অনাদিকাল থেকে তাঁর বিপুল মাতৃক্রোড়ে চন্দ্র, সূর্যাদি শিশুর মতো দোল খায়। তাঁর কল্যাণময়ী রূপের সামান্য ঝলকই যেন স্নিগ্ধ আবেশে অসীম নীলাকাশকে মহিমান্বিত করে রেখেছে।

    সঞ্চারী ও আভোগে- কবি জগৎব্যাপী কালী নানা রূপে বিরাজিত রূপ তুলে ধরেছেন। কবির মনে করেন রাতের অন্ধকার যেন খেয়ালী কালীর কালোর কেশের আন্দোলন, দিনের তীব্র আলো-তাপ যেন দগ্ধ চিতার লীলা। সবই বহুরূপিণী কালীর অসীমরূপ। বিপুল সিন্ধুর এক বিন্দু জলের মতোই কবি রূপের সামান্যই অনুভব করেন। বিশ্বব্যাপী তাঁর বিশাল রূপসৌন্দর্য, তাকে আবৃত করার মতো বসন কোথায়? আর যে বসনেই তাঁকে আবৃত করা চেষ্টা করা যাক না কেন, সে সবও তো কালীর অংশ। সেই কারণেই তিনি নগ্নিকা।
     
  • রচনাকাল ও স্থান:  গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। ১৩৩৮ বঙ্গাব্দের পৌষ (ডিসেম্বর ১৯৩১-জানুয়ারি ১৯৩২) মাসে স্বদেশ পত্রিকায় গানটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ৩২ বৎসর ৭ মাস

    উল্লেখ্য, প্রতিভা সোম লিখেছেন, নজরুল কীর্তন লিখতে শুরু করেছিলেন তাঁর পিসিমার অনুরোধে। প্রতিভা সোম ঢাকা থেকে কলকাতায় এলে চুঁচুড়ায় তাঁর পিসেমশাইর বাড়িতে উঠতেন। তিনি স্থানীয় কলেজিয়েট স্কুলের সহকারী শিক্ষক ছিলেন। শ্যামা সঙ্গীত রচনা করতে শুরু করেছিলেন নজরুল প্রখ্যাত গায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে'র অনুরোধে। ঐ মহৎ শিল্পীর অনুপ্রেরণায় নজরুল সৃষ্টি করেছিলেন,  আর লুকাবি কোথা মা কালী,  কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন ; ইত্যাদি অপূর্ব শ্যামা সঙ্গীত।
    [সূত্র: রফিকুল ইসলামঃ পঞ্চদশ অধ্যায়, শিল্পী জীবন, নজরুল-জীবন, পৃষ্ঠা-৪৫৯ ও ৪৬০।]
  • গ্রন্থ:
    • বনগীতি।
      • প্রথম সংস্করণ [১৩ অক্টোবর ১৩৩২ (রবিবার ২৭ আশ্বিন ১৩৩৯)। আশাবরী-দাদরা। পৃষ্ঠা: ৬৮] ।
      • নজরুল-রচনাবলী। জন্মশতবর্ষ সংস্করণ, পঞ্চম খণ্ড। বাংলা একাডেমী। ঢাকা। জ্যৈষ্ঠ ১৪১৮/মে ২০১১। বনগীতি। গান ৪৭। আশাবরী-দাদরা। পৃষ্ঠা ২০৬।
    • সুরলিপি। [১৬ আগষ্ট ১৯৩৪ (বুধবার, ৩১ শ্রাবণ ১৩৪২)]। জগৎঘটক-কৃত স্বরলিপি। প্রকাশক: নজরুল ইসলাম
  • রেকর্ড: টুইন। [জুন ১৯৩২ (জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় ১৩৩৯)]। এফটি ২০৩১। শিল্পী: মৃণালকান্তি ঘোষ  [শ্রবণ নমুনা]
  • পত্রিকা:
    • স্বদেশ। পৌষ ১৩৩৮ (ডিসেম্বর ১৯৩১-জানুয়ারি ১৯৩২)
    • ভারতবর্ষ [অগ্রহায়ণ ১৩৪০ (নভেম্বর-ডিসেম্বর ১৯৩৩)] কথা ও সুর: কাজী নজরুল ইসলাম। স্বরলিপিকার: জগৎ ঘটক। [ নমুনা]
       
  • সঙ্গীতবিষয়ক তথ্যাবলি:

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।