আমি কলহেরি তরে কলহ করেছি বোঝনি কি রসিক বঁধু (ami koloheri tore koloho korechi bojhoni ki rosik bodhu)

আমি কলহেরি তরে কলহ করেছি বোঝনি কি রসিক বঁধু।
তুমি মন বোঝ মনোচোর মান বোঝ নাকি হে―
তুমি ফুল চেন, চেন নাকি মধু?
তুমি যে মধুবনের মধুকর,
তুমি মধুরম্ মধুরম্ মধুময় মনোহর
কলহেরি কূলে রহে অভিমান-মধু যে, চেন নাকি বঁধু হে―
রাগের মাঝে রহে অনুরাগ-মধু যে, দেখ নাকি বঁধু হে―
কলঙ্কী বলে গগনের চাঁদ প্রতি দিন ক্ষয় হয়
তুমি নিত্য পূর্ণ চাঁদ সম প্রিয়তম চির অক্ষয়
এ চাঁদে একাদশী নাই হে―
শুধু রাধা একা দোষী হলো নিত্য কেন পায় না
মোর কৃষ্ণ চাঁদে যে একাদশী নাই হে―
সেই ব্রজগোপীদের ঘর আছে পর আছে
কৃষ্ণ বিনা নাই রাধার কেহ
আমিও জানি যেন আমারও শ্রীকৃষ্ণ কেবল রাধাময় দেহ।
সে রাধা প্রেমে বাঁধা সে রাধা ছাড়া জানে না, রাধাময় দেহ
সে রাধা প্রেমে বাঁধা।

  • ভাবসন্ধান: পালা-কীর্তন - 'কলহ'-এর জন্য রচিত এই গানের বিষয় হলো- রাধা ও কৃষ্ণ পৃথক কোনো সত্তা নয়, এঁরা বৃন্দাবনের প্রেমময় কৃষ্ণের রঙ্গলীলার অংশভাগী মাত্র। সেখানে  শ্রীকৃষ্ণ কেবলই রাধাময় দেহ। তাই রাধাকৃষ্ণের প্রেম, কলহ, অভিসার যেন মন ভুলানো উপাখ্যান মাত্র। শুধুই সেই লীলার অংশ হিসেবে কৃষ্ণ পরকীয়া দোষে দোষী, আর তারই অংশ হিসেবে রাধা বৃন্দবনের কলঙ্কিনী গোপিনী।

    রাধকৃষ্ণের এই লীলারঙ্গে অভিমানিনী রাধা বলেন- তিনি শুধুই কলহের জন্য কলহ করেছেন- সেটা তাঁর রসিক বঁধুর (কৃষ্ণ) না বোঝার কথা নয়। তিনি মনচোরা বটে, কিন্তু অভিমান উপলব্ধি করতে পারেন না, তেমনটাও নয়।  ফুল হলো মোহ, আর তাঁর প্রেমের নির্যাস হলো- মধু। প্রেমের এই নিগূঢ় রহস্য জানে মধুকর। ফুলরূপিণী রাধার মতো বৃন্দাবনের সখিরাও তেমনি। বৃন্দবনের সে মধুবনের মধুকর হয়ে কৃষ্ণ বিরাজ করেন। তিনি সকল গোপিনীর কাছে  মধুরম্ মধুরম্ (প্রেমমধু) মধুময় (প্রেমময়) ও মনোহর।

    প্রেমে আছে রাগ-অনুরাগ, অভিমান। এরই মাঝে আছে প্রেম হয়ে ওঠে মনোহর হয়ে অভিমান ও অনুরাগে।  কৃষ্ণ কি সে সব জানেন না, রাধার এই আত্ম-জিজ্ঞাসা জেগে ওঠে তাঁর মনে। রাধা জানেন- কলঙ্কিনী চাঁদ তিথিতে তিথিতে ক্ষয় হয়, কিন্তু কৃষ্ণরূপী চাঁদ ক্ষয় নেই। তিনি নিত্য-পূর্ণ, চির অক্ষয়। এই চাঁদের একাদশী নেই। তাই একাদশী ব্রতও নাই। এই প্রেমে যদি রাধা একই দোষী হলে, অন্যান্য তিথিতেও তিনি কৃষ্ণকে কাছে পান না কেন- এ যেন  কৃষ্ণের কাছে অভিমানিনী রাধার  অভিযোগ।

    বৃন্দাবনে ব্রজগোপীদের ঘর আছে, কিন্তু কৃষ্ণের প্রেমে ঘর-বিবাগিনী কলঙ্কিনী রাধার কাছে কৃষ্ণ ছাড়া আর কেউ নেই।  রাধা জানেন শত সখিদের মাঝে কৃষ্ণ শুধুই রাধময়, তিনিই শুধু কৃষ্ণময়। রাধা জানেন তিনি- কৃষ্ণও রাধাময় দেহে রাধার প্রেমে বাঁধা। কারণ উভয়ই জানেন কৃষ্ণেরই রচিত এই প্রেম-লীলায় উভয়ই অংশমাত্র।

     
  • রচনাকাল ও স্থান: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জানুয়ারি (রবিবার ২৮ পৌষ ১৩৪৭) কলকাতা বেতার থেকে 'কলহ' নামক পালা-কীর্তন প্রচারিত হয়েছিল। এই পালা-কীর্তনে এই গানটি ব্যবহৃত হয়েছিল।
     
  • বেতার: কলহ। পালা-কীর্তন । কলকাতা-ক। তৃতীয় অধিবেশন। সময়: ৭.৪০-৮.৩৯  [১২ জানুয়ারি ১৯৪১ (রবিবার ২৮ পৌষ ১৩৪৭)। শিল্পী: শৈল দেবী।
       [সূত্র:
    • বেতার জগৎ।১২শ বর্ষ ১ম সংখ্যা। ১লা জানুয়ারি ১৯৪১, (বুধবার, ১৭ পৌষ ১৩৪৭)] পৃষ্ঠা: ৪৮
    • The Indian-listener [1940, Vol VI, No 1. page 79
       
  • রেকর্ড: সেনোলা [অক্টোবর ১৯৪১ (আশ্বিন-কার্তিক ১৩৪৮) । কিউ এস ৫৩৭। শিল্পী: নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায় (রাণী)। সুর: নজরুল ইসলাম] [শ্রবণ নমুনা]
     
  • স্বরলিপিকার ও স্বরলিপি: সুধীন দাশ। [নজরুল-সঙ্গীত স্বরলিপি, দ্বাদশ খণ্ড। প্রথম সংস্করণ। নজরুল ইন্সটিটিউট আশ্বিন ১৪০৪/অক্টোবর ১৯৯৩। তৃতীয় গান] [নমুনা]
  • পর্যায়:
    • বিষয়াঙ্গ: ধর্মসঙ্গীত। সনাতন হিন্দুধর্ম।  বৈষ্ণব সঙ্গীত। রঙ্গলীলা
    • সুরাঙ্গ: কীর্তনাঙ্গ

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।