আমি পুরব দেশের পুরনারী (ami purob desher puronari)

আমি পুরব দেশের পুরনারী (গো)।
গাগরি ভরিয়া এনেছি গো অমৃত-বারি॥
পদ্মাকূলের আমি পদ্মিনী-বধূ
এনেছি শাপলা-পদ্মের মধু
ঘন বন ছায়ায় শ্যামলী মায়ায়
শান্তি আনিয়াছি ভরি' হেমঝারি॥ 
আমি শঙ্খ-নগর হতে আনিয়াছি শাখা, অভয়শঙ্খ,
ঝিল্‌ ছেনে এনেছি সুনীল কাজল গো ─
বিল্‌ ছেনে অনাবিল চন্দন-পঙ্ক (এনেছি)।
এনেছি, শত ব্রত-পার্বণ-উৎসব
এনেছি, সারস হংসের কলরব
এনেছি, নব আশা-ঊষার সিন্দুর
মেঘ-ডম্বরু সাথে মেঘ-ডুমুর শাড়ি॥

  • রচনাকাল ও স্থান: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে নির্দিষ্ট তারিখ জানা যায় না। কিন্তু সুপ্রভা সরকারের স্মৃতিকথা থেকে- রচনার প্রেক্ষাপট এবং রচনার নিকটবর্তী সময় সম্পর্কে জানা যায়। উল্লেখ্য, ঢাকা বেতার কেন্দ্রে প্রথম সম্প্রচার শুরু হয়েছিল ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর। পরের বছরের ১৬ই ডিসেম্বর এই কেন্দ্রের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে কাজী নজরুল ইসলাম আমন্ত্রিত হয়ে ঢাকা আসেন। তার সঙ্গে শিল্পী হিসেবে ছিলেন অনিমা দাশগুপ্তা, শৈলদেবী, দেবাশীষ দাশগুপ্ত, চিত্তরায়, সুপ্রভা সরকার প্রমুখ। বর্ষপূর্তিতে নজরুলের রচিত, সুরারোপিত এবং পরিচালিত গীতি-নকশা 'পূর্বাণী' সম্প্রচারিত হয়েছিল। এর ধারা বিবরণী দিয়েছিলেন রণেন কুশারী।

    কলকাতা থেকে নজরুল ও সহশিল্পীদের দল গোয়ালন্দ ঘাটে পৌঁছান এবং স্টিমার যোগে নদী পার হওয়ার সময় তিনি এই গানটি রচনা করেছিলেন। এ বিষয়ে সুপ্রভা সরকার তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন─
    ‌‌'আমি পূরব দেশের পুরনারী (গো)" গানটি কাজীদা রচনা করেছিলেন ঢাকা যাবার পথে গোয়ালন্দ থেকে ঢাকাগামী স্টীমারে বসে। সুর সংযোজনাও ওই স্টীমারে। নদী পথে স্টীমার এক এক স্টেশনে থামে, ছোট ছোট ডিঙ্গী নৌকা করে এলাকার লোকজন নানা রকম মিষ্টি বিক্রী করতে আসে। ডিঙ্গীগুলো ঢেউয়ে দোলে, তারই মধ্যে বেচাকেনা হয়। দেখতে বেশ লাগে। ঠিক এরকম দোলানীর মধ্যে যাত্রীরা জাহাজ থেকে নেমে ডিঙ্গী চেপে পাড়ে উঠছে। আমি অবাক হয়ে গেলাম নারীরাও এই দোলানীর মধ্যে স্বাচ্ছন্দে নৌকায় চাপছে দেখে। কাজীদাকে জিজ্ঞাসা করলাম, "আচ্ছা, এই দোলানীর মধ্যে নৌকায় উঠতে মেয়েদের ভয় করে না?" কাজীদা বললেন, না, এরা পূর্ববঙ্গের মেয়ে এদের ভয় নেই। ঠিক এসময় এক মহিলা যাচ্ছিলেন, তিনি কথাটি শুনেই থমকে দাঁড়ালেন এবং কাজীদার দিকে তাকালেন। কাজীদাও তাকে দেখলেন। ফর্সা মহিলা, লালপেড়ে শাড়ি পরেছেন, কপালে সিন্দুরের মোটা বিন্দু। মহিলা চলে যেতে কাজীদা বললেন, "বাঃ"। কিছুক্ষণ পরে দেখলাম রেলিং-এ একপা রেখে হাটুর ওপর এক টুকরো কাগজে লিখতে আরম্ভ করেছেন। লেখা হয়ে গেলে হারমোনিয়াম নিয়ে বসলেন আর গুনগুন করে সুর দিলেন। আমাকে বললেন, তুই গাইবি?  আমি পারবো না বললে শৈল দেবীকে দিলেন। জাহাজেই শেখা হয়ে গেল। এভাবে পূরব দেশের পুরনারী গানটি রচিত হয়েছিল এবং জাহাজের ওপরেই সুর দেওয়া হয়েছিল।
    [সূত্র: কাজীদা, সুধিজনের দৃষ্টিতে নজরুল সঙ্গীত। সুপ্রভা সরকার, পৃষ্ঠা-১৩২ ও ১৩৩]
    [নজরুল যখন বেতারে। আসাদুল হক (বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী। মার্চ ১৯৯৯)। ঢাকা বেতারে নজরুলের 'পূর্বাণী' গীতি-আলেখ্য। পৃষ্ঠা: ২২৬-২২৮।]

    রচনার প্রেক্ষাপটের সূত্র ধরে বলা যায়, গানটি রচনার সময় নজরুলের বয়স ছিল ৪১ বৎসর ৭ মাস।

     
  • গ্রন্থ: নজরুল-সংগীত সংগ্রহ [রশিদুন্‌ নবী সম্পাদিত। কবি নজরুল ইন্সটিটিউট। তৃতীয় সংস্করণ দ্বিতীয় মুদ্রণ, আষাঢ় ১৪২৫। জুন ২০১৮। গান ৮৫। পৃষ্ঠা ২৭]
  • বেতার: পূর্বাণী। ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান। [১৬ ডিসেম্বর ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দ (সোমবার, ১ পৌষ ১৩৪৭)। শিল্পী: শৈল দেবী]
  • রেকর্ড: পাইওনিয়র [মে ১৯৪১  খ্রিষ্টাব্দ মে (বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৮) রেকর্ড নম্বর এনকিউ ১৮১। শিল্পী: শৈল দেবী। সুরকার: নজরুল ইসলাম।   [শ্রবন নমুনা]
     
  • স্বরলিপিকার ও স্বরলিপি: সুধীন দাশ। [নজরুল-সঙ্গীত স্বরলিপি, পঞ্চম খণ্ড। কবি নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা] তৃতীয় গান। পৃষ্ঠা: ৪৪-৪৬। [নমুনা]
  • সুরকার: কাজী নজরুল ইসলাম।
  • পর্যায়:
    • বিষয়াঙ্গ: প্রেম
    • সুরাঙ্গ: দক্ষিণ ভারতীয় সুরশৈলী

 

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।