আয় মা উমা, রাখব এবার ছেলের সাজে সাজিয়ে তোরে (ay maa uma, rakhbo ebar)
(মা) আয় মা উমা! রাখ্ব এবার ছেলের সাজে সাজিয়ে তোরে।
(ওমা) মা'র কাছে তুই রইবি নিতুই, যাবি না আর শ্বশুর-ঘরে॥
মা হওয়ার মা কী যে জ্বালা
বুঝবি না তুই গিরি-বালা,
তোরে না দেখলে শূন্য এ বুক কী যে হাহাকার করে॥
তোর টানে মা শঙ্কর-শিব আসবে নেমে জীব-জগতে,
আনন্দেরই হাট বসাব নিরানন্দ ভূ-ভারতে।
না দেখে যে মা, তোর লীলা
হ'য়ে আছি পাষাণ-শিলা,
আয় কৈলাসে তুই ফির্বি নেচে বৃন্দাবনের নূপুর পরে॥
- ভাবসন্ধান: সনাতন হিন্দু ধর্মের পৌরাণিক কাহিনি মতে- দক্ষ কন্যা সতী, শিবকে স্বামী হিসেবে পাওয়ার জন্য, হিমালয়ের ঔরসে মেনকার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি তপস্যার দ্বারা শিবের ধ্যান ভঙ্গ করে তাঁকে স্বামী হিসেবে পেয়েছিলেন। পৌরাণিক কাহিনি অনুসরণে এই দেবী স্বামী শিবের ঘর করেন, আবার বৎসরান্তে পিতামাতার কাছে আসেন। এই ফিরে আসা এবং ফিরে যাওয়ার মধ্যবর্তী সময়ের উৎসবই সনাতনধর্মী বাঙালিরা দুর্গাপূজা নামে উদ্যাপন করেন।
বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতিতে রয়েছে- শ্বশুড় বাড়ি থেকে কন্যার আগমনে আছে পুনর্মিলনের আনন্দ, বৎসরান্তে তাঁর স্বামীর ঘরে যাওয়ায় মধ্যে রয়েছে পিতামাতার বিচ্ছেদ বেদনা। সনাতন ধর্মী বাঙালি ধর্মদর্শনে দেবী দুর্গা পূজা হলো- ভক্তিমার্গের। কিন্তু চেতনায় থাকে মাতা বা কন্যার আগমন ও বিদায়ের আবেগ। এই গানের শুরুতে উপস্থিত হয়েছে আনন্দময়ীর আগমনীর সাথে সাথে, কন্যা-বিদায়ের বেদনবিধূর আবেগাতাড়িত ক্ষণের দূরাভাস।
এই গানে যিনি আয় মা বলে উমাকে (দুর্গা) তাঁর ঘরে আহবান করছেন, তিনি জনপদের সামগ্রিক সত্তা। এখানে সমগ্র জনপদবাসী নিজেই হয়ে ওঠেছেন 'মাতৃরূপেণ'। এই মা-ও মাতৃরূপেণ সংস্থিতা, এই মা, যে কোন নারী নয়, বরং সমগ্র জনপদবাসীর প্রতিনিধি। তাঁর কাছে এই দেবী 'সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা' (যে দেবী সর্বপ্রাণীতে মাতৃরূপে অবস্থিতা )।
এ মায়ের অপত্য স্নেহে দেবী হয়ে ওঠেন- বৎসরান্তের শ্বশুড় বাড়ি থেকে ফেরা আদুরে কন্যা। তাই এ গানের মাতৃরূপেণ জনগোষ্ঠী উদারভাবে কন্যারূপিণী দেবীকে অপত্যস্নেহে দু হাত বাড়িয়ে আহবান করতে পারেন- 'আয় মা উমা'। সেই স্নেহের দাবীতে বলতে পারেন- তাঁকে আর শ্বশুড় বাড়ি পাঠাবেন না। সর্বদা তাঁকে ছেলে সাজিয়ে বুকের কাছে লুকিয়ে রাখবেন।
মা-কে তাঁর সন্তাদদের জন্য কত কিছু যে সহ্য করতে, তা একমাত্র মায়েরাই জানেন। মা ভাবেন গিরিবালা (পর্বত কন্যা দুর্গা) হয়তো মায়ের এই জ্বালা বুঝতে পারবেন না। কন্যাকে না দেখলে, মায়ের বুকে যে শূন্যতার হাহকার ওঠে, তা যেন ঘরে ফেরা কন্যারূপিণী দেবী বুঝতে পারবেন না।
মা মনে করেন- দুর্গার প্রেমের টানেই শঙ্কর-শিব (কল্যাণকারী শিব), জীবের কল্যাণরূপে নেমে আসবেন জীবজগতে। তাঁর আগমনে নিরানন্দ জগতে বসবে আনন্দের হাট (লেনা দেনার আসর)। দুর্গার অপার লীলার অদর্শনে, সবাই যেন নিষ্ঠুর-শিলায় পরিণত হয়ে আছে। দুর্গা সেখানে মহামিলনের আনন্দের জোয়ার বইয়ে দেবেন- এটাই জনপদের মায়ের কামনা। তাঁর অপার লীলায় দুর্গা হয়ে উঠবেন জগন্মাতা।
মা কখনোই চান না তাঁর কন্যা তাঁর নিজের সংসারের আনন্দ থেকে বঞ্চিত থাকুক। তাই কন্যার আনন্দের জন্য তাঁকে কৈলাসে ফিরে যাবার আশা রাখেন। মা চান তাঁর কন্যারূপণী দুর্গা যেন তাঁর বৃন্দাবনের প্রেম-লীলার নৃত্যানন্দের নূপর পরে ফিরে যান কৈলাসে, তাঁর স্বামীর ঘরে।
- রচনাকাল ও স্থান: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর (ভাদ্র-আশ্বিন ১৩৪৭) মাসে এইচএমভি রেকর্ড কোম্পানি থেকে এই গানটির প্রথম রেকর্ডে প্রকাশিত হয়েছিল। সময় নজরুল ইসলামের বয়স ছিল ৪১ বৎসর ৩ মাস।
- গ্রন্থ: নজরুল-সঙ্গীত সংগ্রহ (নজরুল ইন্সটিটিউট, মাঘ ১৪১৭, ফেব্রুয়ারি ২০১১) নামক গ্রন্থের ৯১৩ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা: ২৮১]
- রেকর্ড: এইচএমভি [সেপ্টেম্বর ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দ (ভাদ্র-আশ্বিন ১৩৪৭)। এন ২৭০০৯। শিল্পী: নিতাই ঘটক। [শ্রবণ নমুনা]
- বেতার: আগমনী কলকাতা বেতারকেন্দ্র-ক। তৃতীয় অধিবেশন। [৬ অক্টোবর ১৯৪০ (রবিবার, ২০ আশ্বিন ১৩৪৭)। সন্ধ্যা: ৭.২০-৮.১৯।
- সূত্র:
- বেতার জগৎ। ১১শ বর্ষ ১৯শ সংখ্যা। ১ অক্টোবর, ১৯৪০। পৃষ্ঠা: ১০৪৪
- The Indian-listener. Vol.V. No. 19. p.1485]
- সূত্র:
- সুরকার: নিতাই ঘটক
- স্বরলিপিকার ও স্বরলিপি:
- আহসান মুর্শেদ। [নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপি, তেপান্নতম খণ্ড, কবি নজরুল ইন্সটিটিউট, আশ্বিন ১৪২৮। সেপ্টেম্বর ২০২১] গান সংখ্যা ৩। পৃষ্ঠা: ২১-২৪ [নমুনা]
- পর্যায়:
- বিষয়াঙ্গ: ধর্মসঙ্গীত। সনাতন হিন্দুধর্ম, শাক্ত। দুর্গাপূজা। আগমনী
- সুরাঙ্গ: খেয়ালাঙ্গ
- রাগ: মিশ্র ভীম পলশ্রী
- তাল: একতাল
- গ্রহস্বর: জ্ঞমা
- আহসান মুর্শেদ। [নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপি, তেপান্নতম খণ্ড, কবি নজরুল ইন্সটিটিউট, আশ্বিন ১৪২৮। সেপ্টেম্বর ২০২১] গান সংখ্যা ৩। পৃষ্ঠা: ২১-২৪ [নমুনা]